আমাদের জীবনে ক্রয়-বিক্রয় একটি আবশ্যিক বিষয়। জমি-জমা কিংবা ফ্লাট বা বাসা-বাড়ী, কল-কারখানা, দোকান-পাট ইত্যাদি ক্রয়- বিক্রয় করতে দলিল সম্পাদন করে থাকি। সমাজের অনেকেই দলিল সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান না থাকার কারণে হয়রানি কিংবা ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে থাকেন। আজকের ইনফোতে দলিল রেজিস্টার করার আগে ও পরে করণীয় কি? এই বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য শেয়ার করা হলো।
দলিল কি?
দলিল হচ্ছে
একটি আইনি নথি, যেখানে সম্পদের ক্রয়-বিক্রয়, চুক্তি কিংবা অন্য কোন দায় সৃষ্টি করে
এবং পক্ষদ্বয়ের বা পক্ষগুলোর সম্মতি লিপিবদ্ধ থাকে। প্রচলিত আইন অনুযায়ী দলিল অনেক
প্রকারের হতে পারে।
দলিলের প্রকারগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে আমাদের সাইটের “দলিলের প্রকারভেদ ও তাদের সংজ্ঞা এবং দলিলকরার নিয়ম” ইনফোটি দেখুন। এখানে দলিল রেজিস্টার করার আগে ও পরে করণীয় কি তা নিয়ে আমরা আলোচনা করা হলো।
আরো জানুন:
অনলাইনে জমির খতিয়ান কিভাবে দেখবেন?
অনলাইনে জমির খাজনা কিভাবে পরিশোধ করবেন?
অনলাইনে ভূমি তথ্য সেবা কিভাবে নিবেন?
অনলাইনে ভূমি মামলার শুনানির আবেদন কিভাবে করবেন?
অনলাইনে নামজারি বা খারিজ কিভাবে করবেন?
দলিল রেজিস্টার করার আগে করণীয় কি?
দলিল রেজিস্টার
করার আগে দলিলটি সম্পাদন করতে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র, দলিল লেখকের দ্বারা দলিল লিখন এবং দলিল
রেজিস্টার অফিসে দাখিল করার পূর্বে দলিলটি ভালভাবে যাচাই করে দেখতে হবে। এছাড়াও দলিল
দাখিলের সময়সূচি, দলিল উপস্থাপনের সময়সীমা জেনে দলিলের রেজিস্ট্রেশন ফি, কর ও শুল্ক
পরিশোধ করে দলিল রেজিস্টার অফিসে দাখিল করা প্রয়োজন হয়। নিচে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
রেজিস্ট্রেশনের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র
দলিল রেজিস্টার
করার জন্য দাখিলের সময় নিম্নলিখিত কাগজপত্রে মূল কপি প্রদর্শন এবং এদের একসেট ফটোকপি
এল. টি. নোটিশের সাথে (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে) সংযুক্ত করতে হবেঃ
১) সংশ্লিষ্ট
জমির সি.এস/ এস.এ/ আর.এস (বি. আর. এস) ও নামজারী খতিয়ানের মূল কপি অথবা সহি মোহরীয়
নকল। আপনার কাছে যদি খতিয়ানের মূল কপি না থাকে বা হারিয়ে কিংবা নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে ইউনিয়ন তথ্যসেবা
কেন্দ্র থেকে আবেদন করে জেলা প্রশাসকের রেকর্ড রুমের খতিয়ান সংগ্রহ করতে পারেন।
২) জমির মাঠ
পর্চা। এটি আপনি সংশ্লিষ্ট উপজেলার সেটেলমেন্ট অফিসারের কার্যালয় থেকে সংগ্রহ করতে
পারবেন। দাগ অথবা খতিয়ান নাম্বার জানা থাকলেই মাঠ পর্চা সংগ্রহ করা যাবে।
৩) জমির দাখিলা।
হাল সন পর্যন্ত ভূমি উন্নয়ণ কর অর্থাৎ খাজনা পরিশোধের রশিদ, যাকে দাখিলা বলা হয়। ইউনিয়ন
সহকারী ভূমি কর্মকর্তার (তহশিলদারের) কার্যালয় থেকে দাখিলা সংগ্রহ করতে পারেন।
৪) ওয়ারিশ
সনদ (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে)। অংশিদার জমি ক্রয়-বিক্রয় করার ক্ষেত্রে ওয়ারিশ সনদ প্রয়োজন
হয়। ইউনিয়ন পরিশোধ থেকে ওয়ারিশ সনদ সংগ্রহ করতে পারেন।
৫) প্রয়োজনীয় বায়া দলিল সমূহ (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে)। দলিল
দাতা যদি ক্রয়কৃত জমির দলিল সম্পাদন করেন তাহলে ক্রয়কৃত দলিলগুলোর প্রয়োজন হবে।
৬) দাতা ও
গ্রহীতার জাতীয় পরিচয়পত্র কিংবা জন্ম সনদপত্র।
৭) দাতা/সম্পাদনকারী/
গ্রহিতাগণের সদ্যতোলা পাসপোর্ট সাইজের রঙিন ছবি।
৮) TIN (টি.
আই. এন) সার্টিফিকেট (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে)।
দাখিলের পূর্বে দলিল যে বিষয়গুলো যাচাই করতে হবে
সনদধারী দলিল লেখকের দ্বারা দলিল লিখে নিতে হবে।
রেজিস্ট্রেশনের জন্য দলিল প্রস্তত হলে সাব-রেজিস্টারের নিকট উপস্থাপনের আগে নিম্নলিখিত
বিষয়গুলো ভাল করে যাচাই করে নিতে হবেঃ
১) দলিলের
প্রতি পৃষ্ঠায় দাতার/পক্ষগণের সম্পাদন আছে কি না যাচাই করা।
২) খতিয়ান
অনুযায়ী জমির দাগ নম্বর অংকে ও কথায় লেখা আছে কি না তা দেখা।
৩) দাগ মোতাবেন
জমির হাত নকশা দলিলে সঠিকভাবে লেখা হয়েছে কি-না যাচাই করে নেওয়া।
৪) সম্পত্তির
শ্রেণী অনুযায়ী সঠিক মূল্য দলিলে লেখা হয়েছে কি-না তা ভাল করে দেখা।
৫) প্রস্তুতকৃত
দলিলে দাতা/বিক্রেতার এবং ক্রেতা/গ্রহিতার বিক্রিত/অর্জিত জমির হারাহারি মালিকানার
পরিমান সঠিকভাবে লেখা হয়েছে কি না যাচাই করা।
৬) কোন কাটা-কাটি
বা ওভাররাইট লেখা দলিল গ্রহণযোগ্য নয়।তাই দলিলে সকল লেখা পরিস্কারভাবে লেখা হয়েছে কি-না
যাচাই করে নিবেন।
রেজিস্টার করার জন্য দলিল দাখিলের সময়সূচি
রেজিস্ট্রি
অফিসগুলো সাধারণত সকাল ১০ ঘটিকা থেকে বিকাল ৩ ঘটিকা পর্যন্ত দলিল সমূহ রেজিস্ট্রেশনের
জন্য গ্রহণ করে থাকে।
রেজিস্ট্রেশন
অফিসের এই সময়সীমা “রেজিস্ট্রেশন বিধিমালা, ২০১৪ এর ১১৩ অনুচ্ছেদ এ উল্লেখ করা হয়েছে।
সম্পাদিত দলিল রেজিস্ট্রি অফিসে দাখিলের সময়সীমা
দলিল সম্পাদন
করার পর তা রেজিস্ট্রি অফিসে উপাস্থাপন করে রেজিস্ট্রেশন করা হয়। দলিলের প্রকারভেদে
উপস্থাপনের সময়সীমার ভিন্নতা রয়েছে। যেমন-
** রেজিস্ট্রেশন আইন, ১৯০৮ এর ২৩ ধারা মতে, দলিল সম্পাদনের
পর রেজিস্ট্রেশনের জন্য রেজিস্ট্রি অফিসে উপস্থাপনের সময়সীমা ৩ মাস।
** আবার বায়নাপত্র পত্র দলিল সম্পাদনের তারিখ হতে ৩০ দিনের মধ্যে উপস্থাপন করতে হবে।
** উইল দলিল
যে কোন সময় উপস্থাপন করা যায়।
দলিল রেজিস্ট্রেশনে আপত্তি কিংবা অভিযোগ
প্রচলিত আইন
অনুসারে, রেজিস্ট্রি অফিসে দলিল রেজিস্ট্রেশন করন বা না-করন সংক্রান্ত কোন অভিযোগ দেওয়া
যায় না। দলিল রেজিস্ট্রি করা বা না-করা সম্পূর্ণ সাব-রেজিস্ট্রারের এখতিয়ার।
আইন অনুযায়ী
সাব-রেজিস্ট্রার এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। তবে দলিল রেজিস্ট্রেশন করার পর কোন
পক্ষ ক্ষতিগ্রস্থ হলে তিনি আদালতের আশ্রয় নিতে পারেন।
দলিল রেজিস্ট্রেশন ফি, কর ও শুল্ক
দলিল রেজিস্ট্রেশনের
জন্য রেজিস্ট্রি ফি, কর ও শুল্ক সরকারি হিসাবে পরিশোধ করতে হবে। প্রচলিত নিয়মে দলিল
লেখক আপনাকে এ কাজে সহায়তা করে থাকবে। এজন্য দলিল লেখক আপনার সাথে চুক্তবদ্ধ হতে পারেন।
সাধারণত দেখা
যায়, দলিল লেখকরা দলিল লিখন থেকে শুরু করে রেজিস্ট্রি করার সকল খরচসহ এবং তার পারিশ্রমিক
যুক্ত করে দলিল দাতা বা গ্রহিতার নিকট চুক্তি করে থাকেন। এক্ষেত্রে আপনি শুধু তাকে
টাকা পরিশোধ করলে আপনার হয়ে তিনি সকল কাজ করে দেন।
সাব-রেজিস্ট্রার আপনার দলিল যে কারণে রেজিস্ট্রেশন না করতে পারে
প্রচলিত রেজিস্ট্রেশন
আইন, ১৯০৮ এর ধারা ৩৫ (৩) অনুসারে বা ক্ষমতাবলে সাব-রেজিস্ট্রার আপনার দলিলটি রেজিস্ট্রেশনের
জন্য গ্রহণ করতে অস্বীকার করতে পারে নিম্নলিখিত কারণগুলোর জন্যঃ
১) যদি কোন
সম্পাদনকারী দলিলের সম্পাদন অস্বীকার করেন তাহলে সাব-রেজিস্টার আপনার দলিলটি রেজিস্ট্রেশন
করবে না।
২) রেজিস্ট্রারিং
অফিসার কোন সম্পাদনকারীকে নাবালক, জড়বুদ্ধি সম্পন্ন কিংবা পাগল বলিয়া মনে করলে, দলিল
রেজিস্ট্রেশন বাতিল করতে পারেন।
৩) দলিল সম্পাদনকারীর
মৃত্যুর পর তাহার প্রতিনিধি বা মনোনীত ব্যক্তি যদি দলিল সম্পাদন অস্বীকার করলে রেজিস্ট্রারিং
অফিসার দলিলটি রেজিস্ট্রেশন করবে না।
দলিল রেজিস্ট্রেশন না হলে করণীয় কি?
সাব-রেজিস্ট্রার
আপনার দলিলটি যে কোন কারণে রেজিস্ট্রেশন বাতিল করতে পারে। সাধারণত ”দলিলে উল্লিখিত
সম্পত্তি তাহার নিজ উপজেলায় নয়” এই কারণ ছাড়া রেজিস্ট্রেশন না করে থাকলে রেজিস্ট্রারিং
অফিসার তার কারণ ২ নং রেজিস্টারে লিপিবদ্ধ করেন। কোন এক পক্ষ আবেদন করলে লিখিত কারণ
সমূহের নকল বিনা খরচে পেয়ে যাবে।
আপনার দলিলটি
যদি সম্পাদনকারী কর্তৃক “সম্পাদন অস্বীকার করা” ব্যতিত অন্য কোন কারণে সাব-রেজিস্ট্রার
রেজিস্ট্রেশন না করেন, তাহলে সাব-রেজিস্ট্রার কর্তৃক অস্বীকৃতির আদেশের তারিখ হইতে
৩০ দিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট জেলা রেজিস্ট্রারের নিকট আপিল করতে পারবেন।
জেলা রেজিস্ট্রার
শুনানি গ্রহনের পর দলিলটি রেজিস্ট্রেশনের আদেশ দিলে ৩০ দিনের মধ্যে সাব-রেজিস্ট্রারের
নিকট দলিলটি দাখিল করতে হবে। দলিল এরুপভাবে দাখিল করা হলে সাব-রেজিস্ট্রার দলিলটি রেজিস্ট্রেশন
করিবেন।
দলিল রেজিস্ট্রেশন করার পর করণীয় কি?
রেজিস্ট্রারি
অফিসে আপনার দলিলটি উপস্থাপন করার পর সাব-রেজিস্ট্রার সেটি গ্রহণ করলে আপনার দলিলটি
রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন হবে। দলিল গ্রহণ করলে আপনি একটি দলিল নাম্বার পাবেন। এই দলিল
নাম্বার দিয়ে দলিলের নকল বা সার্টিফাইড কপি সংগ্রহ করে কাজে লাগাতে পারবেন। দলিল রেজিস্ট্রি
হয়ে গেলে আপনার আরো যে সকল করণীয় তা নিচে উল্লেখ করা হলোঃ
মূল দলিল ফেরৎ গ্রহনের নিয়ম
আপনার দলিল
রেজিস্টার অফিসে দাখিল করার পর সাব-রেজিস্ট্রার কর্তৃক রেজিস্ট্রেশনের জন্য দলিলটি
গ্রহীত হলে আপনি দলিল নাম্বার ও একটি রশিদ পাবেন। রেজিস্ট্রেশন আইন ১৯০৮ এর ৫২ ধারার
অধীন এ রশিদ দেয়া হয় বলে একে “৫২ ধারার রশিদ” বলা হয়। রশিদে মূল দলিল ফেরৎ পাওয়ার একটি
সাম্ভাব্য তারিখ দেওয়া থাকে।
আপনি মূল
দলিল গ্রহণের জন্য অন্য কোন ব্যক্তিকে মনোনিত করতে পারেন। রেজিস্টার অফিসে দলিলের
প্রয়োজনী পৃষ্টাঙ্কন, বালাম বহিতে দলিলের নকল করন ও সূচি বহিতে সূচীকরণ শেষ হলে ফেরৎ
প্রদানের জন্য প্রস্তুতকৃত দলিল সমুহের একটি তালিকা অফিসের নোটিশ বোর্ডে দেয়া হয়। তারপর
আপনার কাছে থাকা ৫২ ধারার রশিদ জমা দিয়ে আপনি বা আপনার মনোনিত ব্যক্তি মূল দলিল গ্রহণ
করতে পারবেন।
যথাসময়ে মূল দলিল গ্রহণ না করলে জরিমানা
দলিল ফেরৎ
গ্রহণের নোটিশ প্রদানের তারিখ হইতে এক মাসের মধ্যে দলিল গ্রহন না করলে পরবর্তী প্রতি
মাস বা তার অংশ বিশেষের জন্য জমিমানা দিতে হবে। দলিল গ্রহণে যত মাস বিলম্ব হবে, জরিমানা
তত গুনতে হবে। তবে জরিমানা ১০০ টাকার বিশি আদায়ের বিধান নাই।
আপনার দলিল
যদি দুই বছরের বেশি রেজিস্ট্রি অফিসে দাবীবিহীন অবস্থায় পড়ে থাকে, তাহলে কর্তৃপক্ষ
দলিলটি ধ্বংশ করে ফেলতে পারে। তাই সময়মত মূল দলিল সংগ্রহ করে যত্নসহকারে সংরক্ষণ করুন।
আশাকরি এই ইনফোটি দলিল করার ক্ষেত্রে আপনাকে সাহায্য করবে। এছাড়াও দলিল সংক্রান্ত আপনার মনে কোন প্রশ্ন থাকলে কমেন্ট করে জানান। আপনার কমেন্ট অনুযায়ী আমরা ইনফোটি আপডেট করে নিবো।
আপনার কাছে এটি প্রয়োজনীয় মনে হলে শেয়ার করে নিজের ওয়ালে রেখে দিন, যাতে প্রয়োজনের সময় নিজের ওয়াল থেকেই সহজেই খুজে পান। আপনার কাছে আমাদের ইনফোগুলো ভাল লাগলে বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া গ্রুপে শেয়ার করে অন্যদের জানার সুযোগ করে দিন।
Home BD info এর অন্যান্য ইনফো জানুন
অ্যাফিলিয়েট মার্কেটিং কি? ঘরে বসে কিভাবে এফিলিয়েট মার্কেটিং করে আয় করবেন?
বিভিন্ন আকৃতির জমি পরিমাপ করার সূত্র ও পদ্ধতি
জমির খতিয়ানের বিভিন্ন ধরণের হিসাব
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
রেস্টি করার কতদিন পর দলিল পাওয়া জায় বা অনলাইনে চেক করা জায়
এটা সু-নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। কারণ আপনার দলিলটি বলাম বহিতে লিপিবদ্ধ করার পর ফেরত প্রদান করা হয়। সাধারণত রেজিস্ট্রি করার মূল দলিল ফেরত পাবেন এক মাস থেকে তিন বছর সময়ের মধ্যে। অর্থাৎ দলিলটি ফেরত পেতে তিন বছর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।