কুরবানি একটি মহান ইবাদত। কোরান সূরা কাওছারে কোরবানির আদেশ দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও অনেক সহীহ হাদিসে কোরবানিকে উৎসাহিত দেওয়া হয়, যে তার সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কোরবানি ত্যাগ করে তাকে হুমকি দেয়া হয়েছে ইসলামে। আজকে আমরা এই ইনফোটিতে আলোচনা করবো “কুরবানি কি? কারা দিবেন এবং কারা দিবেন না?” সম্পর্কে।
অধিকাংশ আলেমদের
মতে, কোরবানি হচ্ছে সুন্নতে মুয়াক্কাদা। সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কুরবানী না করা মাকরূহ।
বিখ্যাত জুরিসপ্রুডেনশিয়াল এনসাইক্লোপিডিয়া আল-মাওসুআতুল ফিকহিয়াতুল ক্বেতিয়াহ
এ বিষয়ে মন্তব্য করেছেন যে, অধিকাংশ ফকীহের অভিমত, তাদের মধ্যে শাফেঈ ও হাম্বলী, ইমাম
মালিক (দুটি মতের মধ্যে প্রধান), আবু ইউসুফ (একটি মত অনুসারে)। . আবু বকর, উমর, বিল্লাল,
আবু মাসউদ আল-বাদারি, সুওয়াইদ ইবনে গাফলাহ, সাঈদ ইবনে মুসায়্যাব, আতা, আলকামাহ, আসওয়াদ,
ইসহাক, আবু সাউর ইবনে মুনযির একই মত প্রকাশ করেছেন। (আল-মাওসুয়াতুল ফিকহিয়্যাতুল কুয়েতিয়্যাহ,
৫/৭৬)
কেননা, হাদিসে
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যখন ১০ই জিলহজ আসে এবং তোমাদের
কেউ কুরবানী করতে চায়, তখন সে যেন তার চুল ও চামড়া দিয়ে কোনো কিছু স্পর্শ না করে।
(সহীহ মুসলিম-5232)
উক্ত হাদীসে
কুরবানী করার কথা ব্যাক্তির ইচ্ছার উপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে। তাই কোরবানি ওয়াজিব নয়,
বরং সুন্নত।
আবদুল্লাহ
ইবনে হিশাম থেকে বর্ণিত (তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পেয়েছিলেন),
যয়নব বিনতে হুমাইদ তাকে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে নিয়ে গেলেন। তিনি আল্লাহর রাসূলকে
বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি তাকে বায়াত করান। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, সে
ছোট। তিনি তার মাথায় হাত রেখে তার জন্য প্রার্থনা করলেন। আর তিনি তার পরিবারের সবার
পক্ষ থেকে একটি ছাগল কোরবানি করেছিলেন। (সহীহ বুখারী-7210)
রাসুলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কুরবানী দিতে চাইতেন, তখন তিনি দুটি বড়, দেখতে
সুন্দর, খাসি করা পুরুষ মেস বা ভেড়া ক্রয় করতেন। তিনি একটি কোরবানি দিতেন তাঁর উম্মতের
পক্ষ থেকে যারা তাওহীদ ও তাঁর নবুওয়াতের সাক্ষ্য দিতেন এবং অন্যটি মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু
‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরিবারের পক্ষ
থেকে। (ইবনে মাজাহ-৩১২২, মুসনাদে আহমাদ)
এ দুটি হাদীসের
ভিত্তিতে ইমাম মালিক, ইমাম আহমদ, ইমাম শাফেঈ রহ. বিশিষ্ট ফকীহগণ বলেন, একটি পরিবারের
পক্ষ থেকে একটি কুরবানীই যথেষ্ট হবে। ইমাম শাফেয়ী রহ. তিনি আরও বলেন, প্রত্যেকের জীবনে
একবার কুরবানী করা সুন্নাত।
হানাফী মাযহাবের
আলেমদের মতে কোরবানি ওয়াজিব। ফিকহ আল-মাওসুআতুল ফিকহিয়াতুল কুয়েতিয়াহ-এর বিখ্যাত
বিশ্বকোষ অনুসারে, আবু হানিফার মতে, কুরবানী ওয়াজিব। এই মত পোষণকারী অন্যান্য ফকীহরা
হলেন: ইমাম মুহাম্মাদ, আবু ইউসুফ (একটি মতানুযায়ী) এবং জুফার। অন্যান্যদের মধ্যে রাবী,
লাইস ইবনে সাদ, আওযাই, ছাওরী এবং ইমাম মালিক এ মত প্রকাশ করেছেন। (এক মত অনুসারে)।
(আল-মাওসুআতুল ফিকহিয়াতুল কুওয়াইতিয়াহ, ৫/৭৭)
তাদের দলীল
হল নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘যার সামর্থ্য আছে কিন্তু কুরবানী
করছে না, সে যেন ঈদগাহে (নামায পড়তে) না আসে। (ইবনে মাজাহ-3123, আল-মুস্তাদরাক-6575)
কাদের ওপর কুরবানি দেওয়া ওয়াজিব বা সুন্নাত?
আমাদের দেশে
কুরবানি দিতে সক্ষম ব্যক্তিকে নিসাব পরিমাণের মালিক বলা হয়। হানাফী মাযহাবের মতে সামর্থ্য
আছে অর্থাৎ নিসাব আছে এমন প্রত্যেকের উপর কোরবানি ওয়াজিব। একটি পরিবারের একাধিক সদস্যের
সামর্থ্য থাকলে তাদের প্রত্যেকের উপর কুরবানী ওয়াজিব। কোরবানি ওয়াজিব বা সুন্নাতে
মুয়াক্কাদাহ যাদের কোরবানি করার সামর্থ্য আছে তাদের জন্য।
কুরবানি দেওয়ার জন্য সক্ষম ব্যক্তি কে তা নিয়ে স্কলারদের মতামত কি?
কোন ব্যক্তির
কুরবানি দেওয়ার সক্ষমতা বা সামর্থ্য আছে তা নিয়ে আলেমদের মধ্যে বিভিন্ন মত রয়েছে।
এই বিষয়ে আল-ফিকহুল ইসলামিউ ও আদিলাতুহুর ভাষ্য হল যে, হানাফী আলেমদের মতে কোন ব্যক্তি
তার এবং তার অধীনস্থ অন্যদের বাসস্থান, পোশাক এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ছাড়াও
200 দিরহাম রুপা বা এই পরিমাণ সম্পদ সক্ষমতা বা অর্থ থাকা। (200 দিরহাম হলো সাড়ে বায়ান্ন
তোলা রুপা) ।
মালেকীদের
মতে কুরবানী দিতে সক্ষম বলে বিবেচিত হবে, যদি কোন ব্যাক্তির দৈনন্দিন খরচ মেটানোর পর
কোরবানি করার সম্পদ থাকে, যা তাদের এক বছরের মধ্যে প্রয়োজন হবে না।
শাফেয়ী আলেমদের
মতে, যদি কোনো ব্যক্তির দৈনন্দিন খরচ মেটানোর পর কুরবানী করার সম্পদ থাকে, তাহলে সে
একজন সক্ষম ব্যক্তি কুরবানি দেওয়ার জন্য।
হাম্বলীদের
কাছে যদি কোনো ব্যক্তি কুরবানীর জন্য সম্পদ অর্জন করতে পারে তবে সে একজন সক্ষম ব্যক্তি।
এমনকি, ঋণ করেও কুরবানী দিলে পরে ঋণ পরিশোধ করতে পারলেও তাদের কাছে কুরবানী করতে সক্ষম
ব্যক্তি হিসাবে গণ্য হয়। (আল-ফিকহুল ইসলামিউ ও আদিলাতুহু, 4/250)
হানাফী মাযহাবে
একজন সামর্থ্যবান ব্যক্তির (অর্থাৎ, কুরবানীর নিসাব পরিমাণ ব্যক্তির) পরিচয় আরও বিশদভাবে
বর্ণনা করা যেতে পারে: প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থ-মনের মুসলিম নারী-পুরুষ যদি ১০ জিলহজ্ব
থেকে ১২ ই জিলহজ্ব তারিখে(নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস ছাড়া) নিসাবের সম্পত্তির মালিক
হন, তাহলে তার উপর কুরবানি করা ওয়াজিব। সম্পত্তি বলতে টাকা-পয়সা, সোনা-রূপা, অলংকার, অতিরিক্ত বাসস্থান
ও খাদ্যের প্রয়োজনে লাগে না এমন জমি ইত্যাদি।
নিসাব কি?
নিসাব হলো
কুরবানি দেওয়ার জন্য ব্যক্তির সম্পদের একটি মানদন্ড। এই মানদন্ড অনুযায়ী যদি কেউ সম্পদ
অর্জন করেন তাহলে তাকে কুরবানি দিতে হবে, নচেৎ তাকে কুরবানি দিতে হবে না। বিভন্ন বস্তুর
নিসাবের ক্ষেত্রে তার মূল্য প্রযোজ্য হতে পারে। যেমন-
স্বর্ণের
ক্ষেত্রে নিসাব সাড়ে সাত (7.5) ভরি, রৌপ্যের ক্ষেত্রে সাড়ে বায়ান্ন (52.5) ভরি,
টাকা ও অন্যান্য বস্তুর ক্ষেত্রে নিসাব হচ্ছে স্বর্ণ কিংবা রৌপ্যের মূল্যের সমান পরিমান
অর্থ।
স্বর্ণ বা
রূপা কোনটিই যদি নিসাব পরিমান না হয় অর্থাৎ স্বর্ণ বা রৌপ্য বা টাকা বা এগুলির যেকোন
একটির আলাদা নিসাব পরিমাণ না থাকে, কিন্তু প্রয়োজনের অতিরিক্ত একাধিক জিনিসের মূল্য
একত্রে যদি সাড়ে বাহান্ন তোলা রূপার মূল্যের সমান হয়ে যায়, তবে তার উপর কুরবানি ওয়াজিব।
(আলমুহীতুল বুরহানী-৮/৪৫৫; ফাতাওয়া তাতারখানিয়া-১৭/৪০৫)
সংগৃহিত তথ্য
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন