ইসলামের সকল কাজ সুন্দরভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে। আল্লাহকে রাজি খুশি করার জন্য পবিত্র ঈদুল আজহার যে কুরবানী আমরা দিয়ে থাকি তার জন্য পশুর নির্ধারিত বয়স ও গুণাগুণ নির্ধারণ করা আছে ইসলামে। হালাল পশু হলেই হবে না নির্ধারিত কিছু গৃহপালিত পশু দিয়ে কুরবানী দিতে হয়। এগুলো হচ্ছে গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা। পবিত্র কুরআনুল কারিমের ভাষায় এ সকল পশুকে বলা হয় 'বাহিমাতুল আনআম' । কোরবানি শুদ্ধ হওয়ার জন্য কোরবানির পশুর বিশেষ কিছু গুণাগুণ থাকা জরুরী। এছাড়াও পশুর নির্ধারিত বয়স না হলে কোরবানির শুদ্ধ হবে না। এই সম্পর্কে আজকের এই ইনফোটিতে আমরা আলোচনা করেছি। চলুন এই বিষয়ে অর্থাৎ কোরবানির পশুর বয়স ও গুণাগুণ কেমন হবে এবং কোরবানির শিক্ষা কি? জেনে যাক।
কুরবানীর সম্পর্কে আমরা ইতিপূর্বে দুটি ইনফো শেয়ার করেছি। যেমন: 'কারা কোরবানি দিবেন এবং কারা কোরবানি দিবেন না' শিরোনামে লেখাটিতে কুরবানীর সম্পর্কে বেসিক কিছু মাসলা মাসায়েল উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়াও কোরবানির কার ওপর ওয়াজিব এবং কোরবানির ইতিহাস সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে "কত টাকা থাকলে কোরবানি ওয়াজিব হয়? কোরবানির ইতিহাস ও কুরবানী কার ওপর ওয়াজিব" এই ইনফোটিতে। এখানে আমরা শুধু কোরবানির পশুর কি কি গুনাগুন থাকা প্রয়োজন এবং কোরবানির পশুর বয়স কত হলে কুরবানী দেওয়া যাবে সেই সম্পর্কে আলোচনা করছি।
কোরবানির নির্ধারিত দিনগুলোতে যে সকল পশু জবাই করা হয় হাদিসের পরিভাষায় এগুলোকে বলা হয় উজহিয়া। পশুগুলো সাধারণত উট- উষ্টি, গরু- গাভী-ষাড়, ছাগল-ভেড়া-দুম্বা যাই হোক না কেন হাদিসের পরিভাষায় এগুলোকে উজহীয়া বলা হয়। এ সকল কোরবানির পশুর বিশেষ কিছু গুণাগুণ থাকা জরুরি।
কুরবানি ঈদ সম্পর্কে আরো ইনফো জানুন
কুরবানীর পশু কেমন হওয়া উচিত?
যেহেতু আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করার লক্ষ্যে কোরবানি দেওয়া হয়, তাই কোরবানির পশু যতটা সম্ভব সুন্দর হওয়া বাঞ্ছনীয়। ইসলামে কুরবানী পশুর নির্ধারিত গুণাগুণ বর্ণনা করা হয়েছে। তাই কোরবানির পশুর সব ধরনের শারীরিক ত্রুটিমুক্ত হওয়া জরুরি। আর গুণগত দিক থেকে সর্ব উত্তম হলো-
* পশুটি দেখতে সুন্দর হতে হবে। সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে যতটা সম্ভব সুন্দর পশু কোরবানি দিতে হবে।
* কোরবানির পশু নিখুঁত বা দোষ ত্রুটিমুক্ত হতে হবে।
* অধিক গোস্ত সম্পন্ন এবং
* পশু হতে হবে হৃষ্টপুষ্ট অর্থাৎ এক কথায় প্রথম দেখায় যা পছন্দ হয়ে যায়।
কেমন পশু দ্বারা কোরবানি জায়েজ নয়?
কোরবানির পশু দোষ ত্রুটিমুক্ত হওয়ার জন্য হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশনা রয়েছে। হাদিসে এসেছে- হযরত বারহা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম আমাদের মাঝে দাঁড়ালেন আর আমার হাত তার হাতের চেয়ে ছোট। তারপর বললেন, চার ধরনের পশু যা দিয়ে কোরবানি করা জায়েজ হবে না। আর পশুগুলো হচ্ছে-
১) অন্ধ: যে পশু চোখে দেখতে পায় না।
২) রোগাগ্রস্থ পশু: যে সকল পশু দেখলেই বোঝা যায় যে সে রোগ বালাইয়ে আক্রান্ত, এরকম পশু যে কোরবানি করা জায়েজ নয়।
৩) পঙ্গু: যে সকল পশু হাঁটাচলা করতে পারেনা।
৪) আহত হওয়া পশু: যে সকল পশুর কোন অঙ্গ ভেঙ্গে গেছে তা স্পষ্ট বোঝা যায়। অর্থাৎ কোন অঙ্গহানি পশু দিয়ে কোরবানি জায়েজ নয়।
হাদিস গ্রন্থ নাসাইতে আহত পশুর স্থলে পাগল উল্লেখ করা হয়েছে । হাদিসের অন্য বর্ণনা এসেছে যে, এ সকল পশু দ্বারা কোরবানি করলে তার কোরবানি পরিপূর্ণ হবে না।
সুতরাং কোরবানির পশু ক্রয় করার সময় উল্লেখিত বিষয়গুলো খেয়াল রাখতে হবে যাতে কোনভাবেই হাদিসে নিষেধ এমন কোন পশু কোরবানির জন্য ক্রয় করা না হয়।
কোরবানির পশুর বয়স কি রকম হতে হয়?
ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিতে কুরবানীর পশুর বয়সের দিকেও বিশেষ খেয়াল রাখতে হয়। কোরবানির পশুর বয়স সম্পর্কে ইসলামের যে বর্ণনা পাওয়া যায় তার নিম্নরূপ:
১) উট: কুরবানীর পশু যদি উট হয় তাহলে কোরবানির সময় উটের বয়স কমপক্ষে পাঁচ বছর হতে হবে। সহজে উট বা উস্ট্রি পাওয়া গেলে তা যেন পাঁচ বছরের নিচে না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। সুতরাং উট কোরবানি দিলে উটের বয়স পাঁচ বছর কিংবা তার উপরে হতে হবে।
২) গরু-মহিষ: গরু বা মহিষ কোরবানি দেওয়ার জন্য তার বয়স কমপক্ষে দুই বছর হতে হবে। দুই বছর কিংবা তার উপরে যে কোন বয়সের গরু বা মহিষ কোরবানি দেওয়া যাবে।
৩) ছাগল-ভেড়া-দুম্বা: আপনি যদি ছাগল বা ভেড়া কিংবা দুম্বা কোরবানি দেন তাহলে তার বয়স কমপক্ষে এক বছর পূর্ণ হতে হবে।
তবে এখানে লক্ষণীয় বিষয়ে যে, কোন পশুর বয়স যদি ৫,২ ও ১ বছর বয়স না হয় কিন্তু দেখতে ৫,২, বা ১ কিংবা তার চেয়ে বেশি বলে মনে হয়। অর্থাৎ দেখতে নাদুস-নুদুস হয়, তবে ওই পশু দিয়ে কোরবানি করা যাবে।
একান্তই যদি উল্লেখিত বয়সের কোন পশু পাওয়া না যায় তবে সেক্ষেত্রে এর চেয়েও কম বয়সি পশু দ্বারা কুরবানী করা জায়েজ হবে। কেননা হাদিসে রয়েছে-
"হযরত জাবের রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু হতে বর্ণিত তিনি বলেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমরা অবশ্যই মুসিন্না (নির্দিষ্ট বয়সের পশু) কোরবানি করবে। তবে তা তোমাদের জন্য দুষ্কর (পাওয়া কষ্টকর) হলে, ছয় মাসের মেসশাবক কোরবানি করতে পারবে।" (মুসলিম)
আল্লাহ তাআলা যেন মুসলিম উম্মাহ সকলকে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও ভালোবাসা অর্জনে ইসলামের শরীয়ত নির্ধারিত সুন্দর, উত্তম ও নির্ধারিত বয়সের পশু কোরবানি করার তৌফিক দেন। আমিন।
কোরবানির শিক্ষা কি?
কুরবানী অর্থ হচ্ছে আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় নিজের সম্পদ উৎসর্গ করা। যেমন হযরত ইব্রাহিম আলাই সালাম আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে নিজের প্রিয় পুত্র হযরত ইসমাইল আলাইহিস সালামকে কুরবানী করার জন্য প্রস্তুত হয়েছিলেন। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে (সূরা-সফফাত ৩৭:১০৮) বলেছেন যে, "পরবর্তীকালের লোকদের জন্য এটাকে দৃষ্টান্ত স্বরূপ স্থাপন করলাম"
পবিত্র কুরআনের এই ঘটনা অর্থাৎ হযরত ইব্রাহিম আলাই সালাম দুনিয়ার সকল কিছুর ওপর অর্থাৎ নিজের সন্তানের জীবনের চেয়েও আল্লাহর হুকুমকে প্রাধান্য দিয়েছেন। আল্লাহর হুকুমের কাছে নিজের এবং তার সন্তানের জীবন তুচ্ছ করে দিয়েছেন। তিনি নিজের সন্তানকে কুরবানী দিতে গিয়ে কোন দ্বিধা দ্বন্দ্ব বোধ করেন নাই কিংবা কোন অজুহাত তুলে ধরেননি। তিনি ইচ্ছা করলে বলতে পারতেন যে-
* হে আল্লাহ আমার বার্ধক্য বয়সে একমাত্র সন্তানকে তুমি এরকম কঠিন আদেশ থেকে আমাকে ক্ষমা করো কিংবা
* হে আল্লাহ, তোমার দ্বীন প্রচারের জন্য ছেলে চেয়েছিলাম, তোমার দ্বীনের কাজের জন্য এই ছেলেটাকে বেঁচে থাকতে দাও কিংবা
*যেহেতু তিনি বিষয়টি স্বপ্নে দেখেছেন, তাই স্বপ্নের উপর ভিত্তি করেই সন্তান কোরবানি করা উচিত হবে কিনা কিংবা স্বপ্নের ব্যাখ্যা ভিন্নভাবে উপস্থাপন করে সন্তান কোরবানি করা থেকে বিরত থাকার পথ খুঁজতে পারতেন, তিনি এরকম কোন অজুহাত না তুলে আল্লাহ তাআলার হুকুমের কাছে সন্তানের জীবনকে উৎসর্গ করে দিলেন। কারণ আল্লাহতালা বলেছেন- "তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি তোমাদের জন্য কেবমাত্র পরীক্ষারস্বরূপ" (সূরা আত তাগাবুন ৬৮:১৫)
হযরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম সেই পরীক্ষা দিয়েছেন। মূলত: মুসলিম উম্মাহর জন্য এটাই আল্লাহতালার নিদর্শন হিসেবে স্থাপন করেছেন যে, তারা সকল অবস্থায় নিজের জান-মাল সন্তান-সন্ততি সহ সকল কিছুর উপর আল্লাহর হুকুম পালন করাকে প্রাধান্য দিবেন। এজন্যই আল্লাহ তাআলা ঘটনাটিকে মুসলমানদের দৃষ্টান্ত হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
সুতরাং কোরবানির মূল শিক্ষা হচ্ছে হযরত ইব্রাহিম আলাই সালাম আল্লাহর হুকুম পালনে যেভাবে নিজের এবং সন্তানের জীবন উৎসর্গ করেছেন ঠিক সেভাবে আমাদেরকেও আল্লাহর হুকুম পালনের ক্ষেত্রে একই রকম ত্যাগ স্বীকার করতে হবে।
হযরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম এর জীবনে আরও একটি ঘটনা রয়েছে। তৎকালীন দেশের প্রধানমন্ত্রীকে বলা হত নমরুদ। হযরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম যখন বললেন যে আল্লাহ তাআলার শাসন ছাড়া আর কারো শাসক মানবো না, নমরুদের শাসন মানা যাবে না। তখন নমরুদ রাজ দরবারে মন্ত্রিপরিষদ বর্গকে নিয়ে রাজসভায় পরামর্শ বসালেন এবং এই সভায় হযরত ইব্রাহিম আলাইহিস সাল্লাম কে রাষ্ট্রদ্রোহী সাব্যস্ত করা হলো।
বর্তমান সময়ে যেমন রাষ্ট্রদ্রোহীদের ফাঁসি দেওয়ার ব্যবস্থা আছে তৎকালীন সময় রাষ্ট্রদ্রোহীদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার জন্য আগুনে পুড়িয়ে মারার প্রচলিত নিয়ম ছিল। হযরত ইব্রাহিম আলাইহি সালামকে রাষ্ট্রদ্রোহীদার অপরাধে আগুনে পুড়িয়ে মারার জন্য নমরুদ পরিষদে বিচার করা হলো। হযরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম আগুনে পুড়ে মরার ভয়ে কিংবা জীবন বাঁচানোর জন্য তিনি নমরুদের শাসন মেনে নেননি। এই পরীক্ষাও তিনি যথাযথ ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছেন এবং সফলকাম হয়েছে।
আল্লাহতায়ালা পবিত্র কুরআনে (সূরা আত তাওবা ৯:১১১) বলেছেন " আল্লাহ মুসলমানদের থেকে তাদের জান ও মাল ক্রয় করে নিয়েছেন জান্নাতের বিনিময়ে"
তাই হযরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম আল্লাহতালার হুকুমকে প্রাধান্য দিয়ে প্রয়োজনে নিজের জীবন বিসর্জন দিতে তৈরি হয়েছেন। সুতরাং মুসলমানদেরকে এভাবেই নিজের জীবনের ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। এটাই মূলত কুরবানীর শিক্ষা।
শেষ কথা:
আশা করি কোরবানির পশুর কি রকম গুণাগুণ থাকা প্রয়োজন এবং কুরবানীর শিক্ষা কি এ বিষয়ে ধারণা পেয়েছেন। এই বিষয়ে আরো কিছু জানার থাকলে কমেন্ট করে আমাদের জানান, আপনার কমেন্টের উপর ভিত্তি করে পরবর্তীতে এই লেখাটি আপডেট করা হবে ইনশাল্লাহ। আর আপনার কাছে এটি প্রয়োজনীয় মনে হলে শেয়ার করে নিজের ওয়ালে রেখে দিন।