টিভি বা খবরের কাগজ খুলে শেয়ার বাজারের খবর দেখা যায়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, শেয়ারবাজার কী? এই শেয়ার বাজার আবার কিভাবে কাজ করে? আপনি আশেপাশের অনেক লোকের কাছ থেকে শুনতে পাবেন যারা শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করেছেন। আমরা আজকে এই ইনফোটিতে “শেয়ার বাজার কি এবং কিভাবে কাজ করে? শেয়ার ক্রয়-বিক্রয় কিভাবে করবেন?” বিস্তাতির আলোচনা করা হবে।
অনেকেই শেয়ার বাজারে ব্যবসা করে লাভবান হচ্ছেন আবার অনেকেই শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করে ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে নিঃস্ব হয়ে যান। তাই আপনাকে শেয়ার বাজারে ব্যবসা করতে হলে আগে থেকেই বেশ কিছু বিষয়ে পরিস্কার ধারণা থাকতে হবে। এখন প্রশ্ন হলো কি কি বিষয়ে ধারণা প্রয়োজন? চিন্তা করবেন না, এই লেখাটিতে বিস্তারতিভাবে আমি বলছি।
শেয়ার বাজার ব্যবসা করতে যা জানা প্রয়োজন
- শেয়ার বাজারে আসলে কি হয়?
- কিভাবে একটি শেয়ারের দাম বাড়ে?
- কিভাবে শেয়ারের দাম কমানো যায়?
- আপনি কিভাবে ভাল শেয়ার চিনবেন?
- কখন শেয়ার কেনা উচিত?
- আর কখন শেয়ার বিক্রি করা উচিত নয়?
এসব বিষয়ে আপনার অবশ্যই ভালো ধারণা থাকতে হবে নইলে। আপনি এ থেকে লাভবান হতে পারবেন না; উল্টো লোকসান গুনতে হবে। রাজ্জাক সাহেব যদি এসব জেনে বিনিয়োগ করতেন তাহলে হয়তো লোকসানের মুখে পড়তেন না।
আরে বন্ধুরা, হয়তো আপনিও এখন এই বিষয়গুলো সম্পর্কে জানতে আগ্রহী, তাই আজকে আমরা শেয়ার বাজারের এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো সম্পর্কে আপনাকে বলতে যাচ্ছি। তাই পুরো লেখাটি মনোযোগ সহকারে পড়ুন।
একটি কথা আছে, "ভাবিয়া কর কাজ, করিয়া ভাব না" তাই আমি আপনাকে বলছি শেয়ার ব্যবসা করার আগে, আপনার শেয়ার বাজার কী তা ভালভাবে বোঝার সাথে ব্যবসা করা উচিত। নইলে সাঁতার না শিখে সাগর পাড়ি দেওয়ার মতো হবে। স্টক মার্কেট কিভাবে কাজ করে তা ভালোভাবে বুঝতে হলে যে বিষয়গুলো বুঝতে হবে তা নিম্নরুপঃ
- শেয়ার বাজারে কি বিক্রি হয়?
- কিভাবে ভাল শেয়ার সনাক্ত করতে?
- সূচক কি? বা শেয়ারবাজারের সূচক কী?
- সূচকের প্রকারভেদ (সূচক)?
- শেয়ারের দাম বাড়ে কেন কমে?
- ষাঁড়ের বাজার এবং ভালুক বাজার কি?
- স্টক মার্কেট কিভাবে ব্যবসা করে?
আমরা যদি উপরের বিষয়গুলো ভালোভাবে বুঝতে পারি তাহলে আমরা শেয়ার বাজার কি, স্টক মার্কেট কিভাবে কাজ করে এবং এর কার্যক্রম ও গতিবিধি সম্পর্কে কিছুটা অনুমান করতে পারি। তাই বিস্তারিত আলোচনা করা যাক।
শেয়ার বাজার কি? What is the stock market?
ইংরেজি Share কে বাংলায় শেয়ার বলে। আর মার্কেটের বাংলা হলো বাজার। স্টক মার্কেট হল এমন একটি বাজার যেখানে স্টক এক্সচেঞ্জে নিবন্ধিত বিভিন্ন পাবলিক লিমিটেড কোম্পানির শেয়ার কেনা-বেচা হয়। আশা করি বুঝতে পেরেছেন শেয়ার বাজার কি।
শেয়ার বাজারে কি বিক্রি হয়?
কোনো কোম্পানি শেয়ারবাজার বা পুজিন বাজারে আসতে চাইলে কোম্পানির মালিক হতে হবে ২০০ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এবং তাদের মূলধন হতে হবে ৩০ কোটি টাকা। তবেই পুজিনের বাজারে কোনো কোম্পানি তালিকাভুক্ত হতে পারে। একটি তালিকাভুক্ত কোম্পানি সাধারণত শেয়ার বাজারে 4 ধরনের জিনিস ক্রয় বিক্রয় করতে পারে।
- শেয়ার (share)
- বন্ড বা ডিবেঞ্চার (Bonds or Debentures)
- মিউচুয়াল ফান্ড (Mutual funds)
- ডেরিভেটিভস (Derivatives)
শেয়ার কি?
পুঁজিবাজারে সবচেয়ে বেশি ব্যবসা করা পণ্য হল শেয়ার, অর্থাৎ একটি কোম্পানির আংশিক মালিকানার প্রতিযোগিতা। শেয়ার যে কোন দিন কেনা যাবে এবং যে কোন দিন বিক্রি করা যাবে। ধরুন আপনি আজকে ACI কোম্পানির 20টি শেয়ার কিনেছেন এবং আপনি চাইলে আজকে বিক্রি করতে পারেন।
বন্ড বা ডিবেঞ্চার কি?
একটি বন্ড বা ডিবেঞ্চার একটি শেয়ারের মতোই মালিকানার একটি অংশ। বন্ড এবং ডিবেঞ্চারগুলির মধ্যে পার্থক্য হল যে বন্ড বা ডিবেঞ্চার কেনার পরে, আপনি যে কোনও সময়ে সেগুলি বিক্রি করতে পারবেন না, যেহেতু একটি নির্দিষ্ট মেয়াদ বা মেয়াদপূর্তি সময় আছে, আপনি সম্পূর্ণ হওয়ার পরেই সেগুলি বিক্রি করতে পারবেন। এর আগে নয়,
আপনি যদি 50000 টাকার একটি বন্ড বা ডিবেঞ্চার ক্রয় করেন এবং এই বন্ড বা ডিবেঞ্চারের মেয়াদ যদি 5 বছর হয় তাহলে আপনি 5 বছর পর বিক্রি করতে পারবেন এবং তার আগে টাকা তুলতে চাইলেও টাকা তুলতে পারবেন। অন্যদিকে, বন্ড বা ডিবেঞ্চারগুলির একটি বড় সুবিধা হল যে মেয়াদ শেষে, আপনি অবশ্যই কিছু লাভ পাবেন যা শেয়ারের ক্ষেত্রে নাও হতে পারে, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, বাংলাদেশের শেয়ার বাজার বন্ড বা ডিবেঞ্চার কেনা-বেচা করা যায় না।
মিউচুয়াল ফান্ড সম্পর্কে কি জান?
মিউচুয়াল ফান্ড হলো এমন একটি ফান্ড যেখানে অনেক লোকের টাকা একসাথে জমা থাকে এবং এই জমাকৃত টাকা একজন শেয়ার বাজার সম্পর্কে অভিজ্ঞ দক্ষ ব্যক্তিকে দেওয়া হয় যিনি বুঝে শুনে সেই টাকা শেয়ার মার্কেটে বিনিয়োগ করেন এবং এখান থেকে যে লাভ হয় তা সবার মধ্যে বন্টন করে দেন।
ব্যাংকে যেমন আমরা টাকা রাখলে নির্দিষ্ট সময় পর ব্যাংক আমাদের সুদ দেয়, ঠিক একই রকম মিউচুয়াল ফান্ড থেকে লাভ বা মুনাফা প্রদান করা হয়। তবে ব্যাংকের চেয়ে মিউচুয়াল ফান্ডে লাভের পরিমান ৩ গুণ বেশি হয়ে থাকে।
“শেয়ার বাজারে কেউ টাকা দিয়ে অভিজ্ঞতা ক্রয় করে আর কেহ অভিজ্ঞতা দিয়ে টাকা ক্রয় করে” বলেছেন ওয়ারেন্ট বাফেট। তাই যারা শেয়ার বাজারে নতুন কিংবা আপনি যদি মনে করেন যে, শেয়ার বাজারের মেকানিজম জানার দরকার নেই, আমার শুধু লাভ পেলেই চলবে। তাহলে আপনার জন্য মিউচুয়াল ফান্ড এ বিনিয়োগ করা উত্তম।
ডেরিভেটিভস
ডেরিভেটিভস হল এমন লেনদেন যা আজ নিষ্পত্তি করা হয়েছে কিন্তু পরে ব্যবসা করা হবে। যেমন: আমের বাগান কেনার ক্ষেত্রে, ব্যবসায়ীরা বাগানে মুকুল আসার সময় গাছ কেনে কিন্তু আম পরে বিক্রি করে, অর্থাৎ লেনদেন পরে হয়, এতে দেখা যায় একই আম গাছ কয়েক জনের কাছে বিক্রি হয়। মনে রাখুন, বাংলাদেশের স্টক মার্কেটে ডেরিভেটিভের কোন লেনদেন হয় না।
স্টক মার্কেটে লাভের উপায় কি?
পুঁজিবাজারে বা শেয়ারবাজারে কোনো কোম্পানির শেয়ার ভালো থাকুক না কেন, সাধারণত ৪টি বিষয়ে মনোযোগ দেওয়া জরুরি। বিষয়গুলো হলঃ
- কোম্পানির ইপিএস
- কোম্পানির ইপিএস বৃদ্ধি
- কোম্পানির ROI
- কোম্পানির PE অনুপাত ইত্যাদি।
কোম্পানির ইপিএস
একটি কোম্পানির ইপিএস (শেয়ার প্রতি আয়) একটি কোম্পানির শেয়ার প্রতি লভ্যাংশ বোঝায়। বছরের শেষে কোম্পানির মোট মুনাফাকে মোট শেয়ার সংখ্যা দিয়ে ভাগ করে ইপিএস (শেয়ার প্রতি আয়) পাওয়া যায়।
একটু সহজ করে বললে, যেমন, একটি কোম্পানির বছর শেষে 100000 টাকা নিট লাভ হয় এবং কোম্পানির শেয়ার সংখ্যা 10000 তাহলে EPS হবে 100000/10000 = 10 টাকা। তাই কোম্পানির শেয়ার প্রতি মুনাফা ১০ টাকা। তাই ভালো ইপিএস আছে এমন কোম্পানির শেয়ার ভালো বলা যায়।
কোম্পানির ইপিএস বৃদ্ধি
ইপিএস গ্রোথ একটি চার্ট বা চার্ট একটি কোম্পানির ইপিএস কয়েক বছর ধরে। যেমন: “A” কোম্পানির 4 বছরের প্রথম বছর 10 টাকা, 2য় বছর 11 টাকা, 3য় বছর 12 টাকা, 4র্থ বছরের 12.5 টাকা। অন্যদিকে, কোম্পানি “B”-এর 4-বছরের EPS হল, প্রথম বছরে 10, টাকা 2য় বছরে 9, 3য় বছরে 11, এবং 4র্থ বছরে 10. তাই সামগ্রিকভাবে বলা যেতে পারে যে কোম্পানি “A” এর ইপিএস প্রবৃদ্ধি ভালো। তাই কোম্পানির ইপিএস প্রবৃদ্ধি ভালো, কোম্পানির শেয়ারও ভালো।
কোম্পানির ROI
কোম্পানির ROI (রিটার্ন অন ইনভেস্টমেন্ট) বলতে, কোন কোম্পানি বিনিয়োগের বিপরীতে কত রিটার্ন বা লাভ করছে (বিনিয়োগ)। বছর শেষে কোম্পানির নিট মুনাফা থেকে কর কর্তন করার পর, কোম্পানির মোট সম্পদের সাথে মুনাফা ভাগ করে, প্রাপ্ত মূল্য ROI পেতে 100 দ্বারা গুণ করা হয়।
উদাহরণস্বরূপ: যদি একটি কোম্পানির কর-পরবর্তী 10 লাখ টাকা এবং কোম্পানির মোট সম্পদ 50 লাখ টাকা হয় তাহলে ROI = 10 লাখ / 50 লাখ * 100 = 20%। সুতরাং একটি কোম্পানির ROI যত বেশি, সেই কোম্পানির শেয়ার তত ভালো।
কোম্পানির PE অনুপাত
ভালো শেয়ার জানার জন্য PE রেশিও (মূল্য উপার্জনের অনুপাত) জানা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। PE অনুপাত হল একটি শেয়ারের বাজার মূল্য (বাজার মূল্য) সেই শেয়ারের মুনাফা দ্বারা ভাগ করে যা প্রাপ্ত হয় তাই PE অনুপাত।
একটু সহজ করে বলি, ধরুন আপনি বাজার থেকে 100 টাকায় 1টি শেয়ার কিনলেন এবং শেয়ার থেকে লাভ হবে 4 টাকা, তাহলে PE রেশিও = 100/4 = 25। এর মানে হল আপনাকে ১০০ টাকা লাভ পেতে 25 বছর অপেক্ষা করতে হবে। অর্থাৎ আপনি যে 100 টাকা শেয়ার কিনেছেন তা 100 টাকা দিয়ে ফেরত নিতে ২৫ বছল অপেক্ষা করতে হবে যদি লাভ হয় 4 টাকা।
তাই বলা যেতে পারে যে বিনিয়োগকৃত টাকা যত কম সময়ে ফেরত পাবেন ততই ভালো। সাধারণভাবে বলতে গেলে, কোম্পানির PE অনুপাত যত কম হবে, কোম্পানির শেয়ার তত ভালো হবে।
এখন আপনারা অনেকেই ভাবছেন যে এগুলো আমরা কোথায় পাব? আমাদের কি এই হিসাব করতে হবে?
উত্তর হল: না আপনাকে কিছু করতে হবে না। একটি কোম্পানির বার্ষিক রিপোর্ট এই সব প্রদান করে. আপনাকে শুধু ওয়েবসাইট থেকে এই তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। তাহলেই ভালো ভালো শেয়ার পাবেন, ইনশাআল্লাহ।
শেয়ার বাজার সূচক কি?
স্টক মার্কেটে আমরা সবচেয়ে সাধারণ যে শব্দটি শুনি তা হল সূচক। সূচক বা মূল্য সূচক হল শেয়ার বাজারে শেয়ারের মূল্য পরিমাপের একক।
অর্থাৎ, যেমন: চাল পরিমাপের একক হল কেজি, তেল পরিমাপের একক হল লিটার এবং শেয়ার পরিমাপের একক হল সূচক বা মূল্য সূচক।
সূচকের প্রকারভেদ (সূচক)? বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে ৩ ধরনের সূচক দেখা যায়?
- X সূচক
- S সূচক
- শীর্ষ 30 সূচক
এখন সেগুলো সংক্ষেপে আলোচনা করা যাক,
X Index: শেয়ারবাজারের সকল শেয়ারকে সাধারণত X Index বলা হয়। স্টক মার্কেটে কোম্পানির বেশিরভাগ শেয়ার এক্স ইনডেক্সের অন্তর্ভুক্ত।
S সূচক: সাধারণত শেয়ার বাজারে শরিয়া ভিত্তিক সমস্ত কোম্পানি এস সূচকের অন্তর্ভুক্ত।
Top30 Index: স্টক মার্কেটে Top30 ব্লু চিপ কোম্পানির শেয়ার নিয়ে গঠিত সূচককে Top30 Index বলা হয়। এখন প্রশ্ন আসতে পারে কীভাবে চিনবেন ব্লু চিপ কোম্পানি?
ব্লু চিপ কোম্পানী হল সেই সকল কোম্পানী যারা ধারাবাহিকভাবে তাদের শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ প্রদান করে এবং কোম্পানীর আর্থিক অবস্থা খুবই ভালো।
মূল্য সূচক বা (সূচক) দেখায় যে একটি দেশের শেয়ার বাজার ভালো অবস্থায় আছে নাকি খারাপ অবস্থায় আছে। আসুন আমরাও ব্যাপারটা একটু বোঝার চেষ্টা করি।
একটি কোম্পানির সূচক গণনা করতে ফ্রি ফ্লো মার্কেট ক্যাপিটাল ব্যবহার করা হয়। মুক্ত প্রবাহ বাজার মূলধন বলতে বাজারে একটি কোম্পানির শেয়ারের মূল্য বোঝায়।
ধরুন একটি কোম্পানির মোট শেয়ার 10,000, কোম্পানিটি 4,000 শেয়ার বাজারে বিক্রির জন্য ছেড়ে দিল এবং বাকি 6,000 শেয়ার নিজের জন্য রাখল। বাজারে বিক্রির জন্য ছেড়ে দেওয়া চার হাজার শেয়ারের মূল্যকে ফ্রি ফ্লো মার্কেট ক্যাপিটাল বলা হয়।
একটি কোম্পানির শেয়ারের সূচক যত বেশি হবে, শেয়ার বাজারে কোম্পানির অবস্থান তত ভালো হবে। আসুন একটি উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টি পরিষ্কারভাবে বোঝার চেষ্টা করি।
কোম্পানি | Index ১০ তারিখ | Index ১১ তারিখ | Index ১২ তারিখ | Index ১৩ তারিখ |
A | ১২৫.৫ | ১২৫.৭৪ | ১৩০.৫ | ১২৭.২ |
B | ১৫০.২ | ১৫০.৫ | ১৫২.৮ | ১৫৫.০ |
C | ১৩৮.২ | ১৩৯.১ | ১৪০.১৫ | ১৪৫.০ |