বর্তমান সময়ে বিশ্বজুড়ে ইসলামিক ফিন্যান্সের আলোচনায় একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সুকুক। বাংলাদেশেও এটি ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। তবে কয়েক বছর আগেও এটি খুব বেশি পরিচিত ছিল না। বাংলাদেশ সরকার ২০১৯ সালের ২৯ মে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি'র মাধ্যমে সুকুক বিষয়ে একটি গেজেট প্রকাশ করে, যা ইসলামিক ফিন্যান্সে একটি নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে।
এই ইনফোটিতে আমরা সুকুকের ধারণা, বৈশিষ্ট্য, বৈশ্বিক অবস্থান, এবং বাংলাদেশে এর প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে আলোচনা করব।
সুকুক কী?
সুকুক আরবি শব্দ, যার অর্থ দলিল বা সার্টিফিকেট। এটি মূলত সম্পদের প্রতিনিধিত্ব করে এবং শরিয়াভিত্তিক একটি অর্থায়ন পদ্ধতি। সুকুক সাধারণত একটি নির্দিষ্ট প্রকল্প বা অ্যাসেটের ভিত্তিতে ইস্যু করা হয়, যা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে সমান আনুপাতিক মালিকানা প্রদান করে। এটি শেয়ার বা বন্ডের মতো নয় বরং সম্পূর্ণ শরিয়াভিত্তিক এবং সুদমুক্ত।
শেয়ার এবং বন্ডের সঙ্গে পার্থক্য
শেয়ারের সঙ্গে পার্থক্য
শেয়ার পুরো কোম্পানির সম্পত্তির ওপর মালিকানা দেয়, যেখানে সুকুক নির্দিষ্ট প্রকল্প বা অ্যাসেটের উপর ভিত্তি করে ইস্যু হয়।
শেয়ারহোল্ডারদের এজিএমে ভোটাধিকারের সুযোগ থাকে, কিন্তু সুকুক হোল্ডারদের নেই।
বন্ডের সঙ্গে পার্থক্য
বন্ড হলো সুদভিত্তিক একটি ঋণপত্র, যেখানে সুকুক শরিয়া সম্মত পদ্ধতিতে প্রফিট শেয়ারিং বা ইজারা (ভাড়া) কন্ট্রাক্টের মাধ্যমে আয় প্রদান করে।
বন্ডে আয় নিশ্চিত, কিন্তু সুকুকে আয় প্রকল্পের সফলতার ওপর নির্ভর করে।
সুকুকের বৈশিষ্ট্য
সুকুকের তিনটি মূল বৈশিষ্ট্য রয়েছে:
বিশেষ প্রকল্পভিত্তিক ফান্ড সংগ্রহ: এটি নির্দিষ্ট প্রকল্প বা অ্যাসেটের জন্য ইস্যু করা হয়।
আন্ডারলাইং অ্যাসেট: সুকুক ইস্যু করার পেছনে একটি সুনির্দিষ্ট অ্যাসেট থাকে, যা থেকে প্রফিট জেনারেট হয়।
শরিয়াভিত্তিক কন্ট্রাক্ট: সুকুকের কার্যক্রম সম্পূর্ণ শরিয়ার নিয়ম অনুযায়ী পরিচালিত হয়, যেমন ইজারা, মুদারাবা, মুশারাকা ইত্যাদি।
বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট
বিশ্বব্যাপী ইসলামিক ফিন্যান্স অ্যাসেটের ১৭% অংশ সুকুকের দখলে, যার মূল্য ৪২৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (থমসন রয়টার্স, ২০১৭)। মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, এবং ইন্দোনেশিয়া সুকুক ইস্যু করার ক্ষেত্রে শীর্ষস্থানীয় দেশ। ১৯৭৮ সালে জর্দানে প্রথম সুকুক ইস্যু শুরু হয়, এবং পরবর্তীতে এটি বৈশ্বিক বাজারে জনপ্রিয়তা লাভ করে।
বাংলাদেশে সুকুকের যাত্রা
বাংলাদেশে সুকুকের প্রচলন নতুন হলেও এর সম্ভাবনা অত্যন্ত উজ্জ্বল। বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যে সরকারি সুকুক (Sovereign Sukuk) ইস্যু করার ঘোষণা দিয়েছে। এর মাধ্যমে দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নে ফান্ড সংগ্রহের একটি টেকসই ও শরিয়াভিত্তিক মাধ্যম তৈরি হবে।
ইতিমধ্যেই সম্পন্ন কার্যক্রম
২০১৯ সালে বিএসইসি কর্তৃক সুকুক বিষয়ে গেজেট প্রকাশ।
সুকুক নিয়ে দুটি আন্তর্জাতিক কর্মশালা।
আইএফএ কনসালটেন্সি লিমিটেড কর্তৃক আয়োজিত আন্তর্জাতিক মানের ট্রেনিং প্রোগ্রাম।
চ্যালেঞ্জ
শরিয়া পরিপালন নিশ্চিত করা।
সাধারণ জনগণের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো।
সেকেন্ডারি মার্কেটে কার্যকর লেনদেন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা।
সুকুকের গুরুত্ব
অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে
এটি একটি টেকসই ও সুদমুক্ত অর্থায়ন পদ্ধতি।
সম্পদভিত্তিক হওয়ায় ঝুঁকির পরিমাণ কম।
অবকাঠামোগত উন্নয়নে সরাসরি ভূমিকা রাখে।
সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে
সুদভিত্তিক অর্থব্যবস্থা থেকে উত্তরণের সুযোগ।
সামগ্রিক সম্পদের সুষম বণ্টনে সহায়ক।
উপসংহার
সুকুক হলো একটি আধুনিক, টেকসই, এবং শরিয়াভিত্তিক অর্থায়ন পদ্ধতি, যা বাংলাদেশসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশের অর্থনীতির উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তবে সুকুক থেকে সর্বোচ্চ সুফল পেতে হলে এর শরিয়া পরিপালন এবং সচেতনতা বৃদ্ধির ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া জরুরি। সরকারের উদ্যোগগুলো যদি সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয়, তবে সুকুক বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কাঠামোতে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করবে।
আরো জানুন:
ইসলামী শরীয়াহ মোতাবেন বাংলাদেশে কিভাবে ইনভেস্ট করবেন?
প্যাসিভ ইনকাম কি? কিভাবে প্যাসিভ ইনকাম শুরু করবেন?
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন