প্রসব প্রাকৃতিক একটি প্রক্রিয়া, তবে এটি মায়ের শারীরিক অবস্থা, শিশুর অবস্থান এবং অন্যান্য বিভিন্ন বিষয়ে নির্ভর করে। এর মধ্যে শিশুর সঠিক অবস্থান সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রসবের সময় শিশুর "মাথার অংশ" আগে বের হওয়া স্বাভাবিক প্রসবের সম্ভাবনাকে বহুগুণ বাড়িয়ে তোলে।
আসুন এই বিষয়ে আরও বিস্তারিত জানি।
শিশুর অবস্থান এবং প্রসব: কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ?
গর্ভাবস্থার শেষ দিকে, অর্থাৎ ৩৭ সপ্তাহের পর, শিশুর সঠিক অবস্থান নিশ্চিত করা খুব গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত, শিশুর মাথা মায়ের পেলভিসের দিকে নেমে আসে, যা "সেফালিক প্রেজেন্টেশন" নামে পরিচিত।
এই অবস্থান স্বাভাবিক প্রসবকে সহজ এবং ঝুঁকিমুক্ত করে। সেফালিক অবস্থানে শিশুর মাথা প্রথমে বের হয়, যা মায়ের প্রসব পথের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। অন্যদিকে, শিশুর পা, কাঁধ বা নিতম্ব আগে বের হলে জটিলতা বাড়ে এবং সিজারিয়ানের সম্ভাবনা তৈরি হয়।
শিশুর কোন অংশ আগে বের হওয়া উচিত?
১. সেফালিক প্রেজেন্টেশন (মাথা আগে বের হওয়া)
এই অবস্থান সবচেয়ে আদর্শ এবং সাধারণ। সেফালিক প্রেজেন্টেশনের বৈশিষ্ট্য:
- শিশুর মাথা প্রথমে মায়ের পেলভিসের দিকে থাকে।
- মাথার আকার পেলভিসের পথের সঙ্গে মানানসই হওয়ায় প্রসব সহজ হয়।
- মাথা বের হওয়ার পরে শিশুর শরীর স্বাভাবিকভাবে বের হতে পারে।
২. ব্রিচ প্রেজেন্টেশন (পা বা নিতম্ব আগে বের হওয়া)
ব্রিচ অবস্থানে শিশুর পা বা নিতম্ব আগে বের হয়। এটি একটি অস্বাভাবিক অবস্থান এবং স্বাভাবিক প্রসবের জন্য উপযুক্ত নয়।
- এই অবস্থানে প্রসব ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।
- মায়ের প্রসব যন্ত্রণা দীর্ঘায়িত হতে পারে।
- এই ক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময় সিজারিয়ান করানো প্রয়োজন হয়।
৩. ট্রান্সভার্স লাই (কাঁধ আগে বের হওয়া)
এই অবস্থানে শিশুর কাঁধ বা পাশ আগে বের হওয়ার চেষ্টা করে।
- এটি একটি জটিল অবস্থান।
- ট্রান্সভার্স লাইয়ে স্বাভাবিক প্রসব সম্ভব নয় এবং সিজারিয়ান অপরিহার্য।
শিশুর অবস্থান বুঝতে মায়েদের করণীয়
১. নিয়মিত আল্ট্রাসাউন্ড করান: গর্ভাবস্থার শেষ দিকে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী আল্ট্রাসাউন্ড করে শিশুর অবস্থান নিশ্চিত করুন।
২. চিকিৎসকের সঙ্গে আলোচনা করুন: যদি শিশুর অবস্থান ব্রিচ বা ট্রান্সভার্স হয়, তাহলে ডাক্তার কিছু নির্দিষ্ট ব্যায়াম বা পদ্ধতির পরামর্শ দিতে পারেন।
৩. ব্যায়াম ও প্রাকৃতিক পদ্ধতি: কিছু সময় শিশুর অবস্থান ঠিক করতে "এক্সটার্নাল সেফালিক ভার্শন" (ECV) পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়, যা শুধুমাত্র বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দ্বারা করা সম্ভব।
৪. সঠিক পরিকল্পনা করুন: ব্রিচ অবস্থায় সিজারিয়ানই সাধারণত সেরা সমাধান। এ বিষয়ে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী আগাম প্রস্তুতি নিন।
বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন?
বিশেষজ্ঞরা একমত যে সেফালিক প্রেজেন্টেশন স্বাভাবিক প্রসবের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) অনুযায়ী, প্রসবের সময় ৯৫%-এরও বেশি ক্ষেত্রে শিশুর সঠিক অবস্থান সেফালিক হয়। তবে, ব্রিচ বা ট্রান্সভার্স অবস্থান প্রায় ৫% ক্ষেত্রে দেখা যায় এবং এতে বাড়তি যত্ন এবং পদ্ধতির প্রয়োজন হয়।
স্বাভাবিক প্রসবের সম্ভাবনা বাড়াতে মায়ের জন্য পরামর্শ
১. স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করুন: নিয়মিত পুষ্টিকর খাবার খান এবং শারীরিকভাবে সক্রিয় থাকুন।
২. সঠিকভাবে বসুন ও ঘুমান: মায়ের বসার ভঙ্গি শিশুর অবস্থানে প্রভাব ফেলতে পারে। সোজা হয়ে বসা এবং ডান বা বাঁ পাশে কাত হয়ে ঘুমানো উপকারী।
৩. ডাক্তারের পরামর্শ অনুসরণ করুন: চিকিৎসকের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখুন এবং যেকোনো সমস্যা হলে দ্রুত জানাতে দ্বিধা করবেন না।
সাধারণ ডেলিভারির লক্ষণ: কীভাবে বুঝবেন প্রসব শুরু হওয়ার সময় এসেছে?
গর্ভাবস্থার শেষ ধাপে এসে প্রত্যেক মা অপেক্ষা করেন তার সন্তানের আগমনের জন্য। সাধারণ ডেলিভারির আগে কিছু লক্ষণ দেখা দেয়, যা মায়েদের বুঝতে সাহায্য করে যে প্রসব শুরু হওয়ার সময় খুব কাছাকাছি। এই লক্ষণগুলো প্রকৃতির স্বাভাবিক প্রক্রিয়ারই অংশ এবং এগুলোকে চিনে রাখা প্রত্যেক মায়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আসুন জেনে নিই স্বাভাবিক প্রসবের প্রাথমিক লক্ষণ এবং উপসর্গগুলো।
সাধারণ ডেলিভারির লক্ষণ
১. শিশুর "ড্রপ" করা (লাইটেনিং)
প্রসব শুরুর প্রায় ২ সপ্তাহ আগে শিশুটি মায়ের পেলভিসের গভীরে নেমে আসে। এই প্রক্রিয়াটি "লাইটেনিং" নামে পরিচিত।
- এটি মায়ের শ্বাস-প্রশ্বাসকে স্বাভাবিক করে তোলে কারণ শিশুটি ফুসফুসের উপর চাপ কমিয়ে দেয়।
- তবে, এর ফলে মূত্রাশলের উপর চাপ বাড়ে, যার কারণে প্রস্রাবের জন্য প্রয়োজনীয়তা বেড়ে যায়।
২. শ্লেষ্মা প্লাগ পাসিং
প্রসব শুরুর আগে সার্ভিক্সের কাছাকাছি থাকা শ্লেষ্মা প্লাগটি বের হয়ে যায়। এটি একটি বড় লক্ষণ যে প্রসব শুরু হওয়ার সময় ঘনিয়ে আসছে।
- শ্লেষ্মা প্লাগটি যোনি স্রাবে রক্তের মতো দেখাতে পারে, যা "ব্লাডি শো" নামেও পরিচিত।
- এটি সাধারণত প্রসব শুরুর এক বা দুই দিন আগে ঘটে।
৩. সার্ভিকাল প্রসারণ এবং ক্ষয়
প্রসবের জন্য প্রস্তুতির সময় সার্ভিক্স প্রসারিত হয় এবং এর টিস্যু পাতলা হতে শুরু করে।
- এই পরিবর্তনগুলো সাধারণত আপনার চিকিৎসক অভ্যন্তরীণ পরীক্ষার মাধ্যমে শনাক্ত করতে পারেন।
৪. পিঠে ব্যথা এবং ক্র্যাম্পিং
প্রসব শুরুর আগে অনেক মায়ের পিঠে ব্যথা এবং তলপেটে ক্র্যাম্প অনুভূত হয়।
- এই ব্যথাগুলো পেশী এবং জয়েন্টগুলো প্রসবের জন্য প্রস্তুত হওয়ার কারণে হয়।
৫. লিগামেন্ট শিথিল হওয়া
গর্ভাবস্থার শেষ দিকে লিগামেন্টগুলো শিথিল হতে শুরু করে।
- এর ফলে শরীরে শিথিলতা অনুভূত হতে পারে। এটি জন্মের জন্য শরীরের স্বাভাবিক প্রস্তুতির অংশ।
৬. ডায়রিয়া
মলদ্বারের পেশীগুলো প্রসবের জন্য শিথিল হতে থাকে, যার কারণে অনেক সময় ডায়রিয়া হতে পারে।
- যদিও এটি অস্বস্তিকর হতে পারে, এটি প্রসবের একটি সাধারণ প্রক্রিয়া।
৭. ওজন পরিবর্তন
গর্ভাবস্থার শেষ ধাপে অনেক মায়ের ওজন বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যেতে পারে বা সামান্য কমতেও পারে।
- এটি শরীরের তরল পরিমাণ হ্রাস পাওয়ার কারণে ঘটে।
৮. অবসাদ বা "নেস্টিং প্রবৃত্তি"
অনেক মা প্রসবের আগে ক্লান্তি অনুভব করেন, আবার অনেক সময় শরীরে অস্বাভাবিক এনার্জি দেখা যায়।
- "নেস্টিং প্রবৃত্তি" নামে পরিচিত এই প্রবণতায় মায়েরা তাদের শিশুর আগমনের জন্য ঘর পরিষ্কার বা প্রস্তুত করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
প্রসব শুরু হওয়ার ইঙ্গিত: কীভাবে প্রস্তুত হবেন?
প্রসবের এই লক্ষণগুলো দেখা দিলে ঘাবড়ানোর প্রয়োজন নেই। তবে, কিছু বিষয় মায়েদের খেয়াল রাখা উচিত:
- চিকিৎসকের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ: শ্লেষ্মা প্লাগ পাসিং, তীব্র পিঠে ব্যথা বা যেকোনো অস্বাভাবিক লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলুন।
- প্রসব ব্যথার পর্যবেক্ষণ: যদি ব্যথা নিয়মিত এবং সময়ের সঙ্গে বাড়তে থাকে, তবে এটি প্রকৃত প্রসব ব্যথা হতে পারে।
- হাসপাতালের জন্য প্রস্তুতি: প্রসবের সম্ভাবনা দেখা দিলে আগে থেকেই হাসপাতালের প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র গুছিয়ে রাখ।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন