মা হওয়া প্রতিটি নারীর জীবনে একটি দারুণ অভিজ্ঞতা। তবে এই নতুন যাত্রার সঙ্গে আসে শরীর এবং ত্বকে কিছু পরিবর্তন, যা অনেক সময় অস্বস্তি তৈরি করতে পারে। প্রসবের পর শরীরের সঠিক যত্ন নেওয়া জরুরি, কারণ এই সময় আপনার শরীর এবং ত্বকের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসার প্রক্রিয়া শুরু হয়।
সন্তান জন্মের পর মায়েদের ত্বক ও চুলের যত্ন নিয়ে সহজ পরামর্শ
সন্তান জন্মের পর মায়েদের শরীরে প্রচুর পরিবর্তন আসে, যা ত্বক ও চুলের উপরেও প্রভাব ফেলে। হরমোনের তারতম্য, শারীরিক ক্লান্তি এবং সময়ের অভাবে অনেক মা নিজের যত্ন নিতে পারেন না। তবে সহজ কিছু উপায় মেনে চললে ত্বক ও চুল সুস্থ রাখা সম্ভব।
১. পোস্টপার্টাম হেয়ার লস সামলানোর উপায়
সন্তান জন্মের পর চুল পড়া, যাকে পোস্টপার্টাম হেয়ার লস বলা হয়, বেশ সাধারণ একটি সমস্যা। অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় প্রোজেস্টেরন হরমোন বেড়ে যায়, যা সন্তানের জন্মের পর কমতে শুরু করে। এর ফলে চুল পড়ার প্রবণতা বাড়ে। তবে কয়েক মাস পর নতুন চুল উঠতে শুরু করে।
যত্নের উপায়:
- প্রতিদিন ডায়েটে প্রচুর ফল, সবজি এবং প্রোটিন রাখুন। এগুলি অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট সরবরাহ করে, যা চুলের গোড়া মজবুত করে।
- চুলে সপ্তাহে একবার নারকেল তেল গরম করে ম্যাসাজ করুন।
- রাসায়নিক হেয়ার ডাই বা রঙ ব্যবহার এড়িয়ে চলুন।
২. ত্বকের যত্নের সহজ টিপস
হরমোনের পরিবর্তনের কারণে ত্বকে তৈলাক্ত ভাব, ব্রণ, র্যাশ, এবং ছোপ-দাগ দেখা দিতে পারে। এই সময়ে অতিরিক্ত যত্ন নেওয়ার সময় না হলেও, দৈনন্দিন পরিচর্যা করা জরুরি।
যত্নের উপায়:
- দিনে অন্তত একবার ত্বক পরিষ্কার করুন। নিজের ত্বকের ধরণ অনুযায়ী একটি ভালো মানের ক্লিনজার ব্যবহার করুন।
- বাজারচলতি রাসায়নিকযুক্ত ক্রিমের বদলে প্রাকৃতিক উপকরণ ব্যবহার করুন, যেমন অ্যালোভেরা, চন্দন, বা মুলতানি মাটি।
- ত্বক নরম রাখতে সকালে এবং রাতে একটি ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করুন।
৩. সানস্ক্রিন ব্যবহার করুন
অনেকেই মনে করেন প্রেগন্যান্সি চলাকালীন বা সন্তান জন্মের পর সানস্ক্রিন ব্যবহার করা উচিত নয়। কিন্তু ডার্মাটোলজিস্টরা বলেন, এটি একেবারেই ভুল ধারণা।
যত্নের উপায়:
- নিয়মিত সানস্ক্রিন ব্যবহার করুন, যা ত্বককে সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি থেকে রক্ষা করবে।
- সূর্যের আলোয় বেরোনোর অন্তত ১৫-২০ মিনিট আগে সানস্ক্রিন লাগান।
৪. পর্যাপ্ত জল পান করুন
ত্বক এবং চুলের স্বাস্থ্যের জন্য হাইড্রেশন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
যত্নের উপায়:
- প্রতিদিন অন্তত ৮ গ্লাস জল পান করুন।
- জল শরীর থেকে টক্সিন বের করতে সাহায্য করে, যার ফলে ত্বকে উজ্জ্বলতা ফিরে আসে।
৫. রাসায়নিক পণ্য এড়িয়ে চলুন
সন্তান জন্মের পর ত্বক এবং চুলে রাসায়নিকযুক্ত পণ্য ব্যবহার করা বিপজ্জনক হতে পারে।
যত্নের উপায়:
- রাসায়নিকযুক্ত হেয়ার ডাই ব্যবহার করবেন না।
- প্রাকৃতিক উপাদান যেমন নারকেল তেল, অ্যালোভেরা, এবং মধু ব্যবহার করুন।
৬. ঘরোয়া যত্নের উপায়
ক্লিনজিং, ময়েশ্চারাইজিং এবং ত্বকের পুষ্টির জন্য ঘরোয়া পদ্ধতি বেছে নিন।
ঘরোয়া ফেসপ্যাকের রেসিপি:
- ২ টেবিল চামচ মুলতানি মাটি, ১ টেবিল চামচ গোলাপ জল, এবং ১ চামচ মধু মিশিয়ে ফেসপ্যাক তৈরি করুন। এটি ত্বকের অতিরিক্ত তৈলাক্ত ভাব কমায় এবং উজ্জ্বলতা বাড়ায়।
৭. ভালো ঘুম এবং মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন
সন্তান জন্মের পর মায়েদের পর্যাপ্ত বিশ্রাম না হওয়ায় শরীর এবং ত্বকে ক্লান্তি ফুটে ওঠে।
যত্নের উপায়:
- রাতে ভালো ঘুমানোর চেষ্টা করুন।
- নিজের মানসিক চাপ কমাতে হালকা ব্যায়াম বা মেডিটেশন করুন।
৮. স্বাস্থ্যকর খাদ্যতালিকা
সুষম খাবার প্রসব-পরবর্তী যত্নের একটি বড় অংশ। খাবারে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন, ভিটামিন, ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড এবং আয়রন যুক্ত করুন। টাটকা শাকসবজি, ফলমূল, বাদাম, ডিম, দুধ এবং দই ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়াতে সহায়ক।
৯.চুলের যত্ন
শিশু জন্মের পর চুল পড়া বা শুষ্ক হওয়া স্বাভাবিক। তেলের ম্যাসাজ করুন এবং ভালো মানের শ্যাম্পু ও কন্ডিশনার ব্যবহার করুন। সপ্তাহে একবার ডিম, মধু, বা দইয়ের মতো প্রাকৃতিক হেয়ার প্যাক ব্যবহার করতে পারেন।
যেগুলো প্রায় সবাই ভুল করে থাকে
১. অতিরিক্ত ওজন কমানোর চেষ্টায় তাড়াহুড়ো করা
মা হওয়ার পর অনেক নারী দ্রুত আগের মতো স্লিম ও ফিট হতে চান, কিন্তু দুঃখের বিষয়, অতিরিক্ত ওজন কমানোর জন্য কিছুতেই তাড়াহুড়ো করা উচিত নয়। বাচ্চাকে দুধ খাওয়ানোর সময় শরীরের জন্য শক্তির প্রয়োজন হয় এবং হরমোনাল পরিবর্তনের কারণে দ্রুত ওজন কমানো কঠিন হতে পারে। তাড়াহুড়ো না করে ধীরে ধীরে স্বাস্থ্যকর খাদ্য ও ব্যায়ামের মাধ্যমে ওজন কমানোর চেষ্টা করুন।
২. ত্বকের যত্নে অযত্ন
মা হওয়ার পর ত্বকে একাধিক পরিবর্তন হতে পারে—পিগমেন্টেশন, ড্রাইনেস, স্ট্রেচ মার্কস ইত্যাদি। কিন্তু অনেকেই ব্যস্ততার কারণে ত্বকের জন্য যত্ন নিতে ভুলে যান। এমনকি, অনেক মায়েরা মনে করেন, ত্বকের যত্ন শুধুমাত্র প্রসাধনী ব্যবহারেই হতে পারে, কিন্তু এটি সম্পূর্ণ ভুল। ত্বককে ভিতর থেকে হাইড্রেট রাখা এবং সঠিক ডায়েট নেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভিটামিন সি, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও হাইড্রেটিং ক্রিম ব্যবহার করুন, পাশাপাশি ময়েশ্চারাইজার ও সানস্ক্রিন ব্যবহারের গুরুত্ব ভুলে যাবেন না।
৩. পর্যাপ্ত পানি না খাওয়া
মা হওয়ার পর আপনার শরীরের জন্য প্রচুর পরিমাণে পানি দরকার। কিন্তু অনেক সময় ক্লান্তির কারণে মায়েরা মনে করেন পানি খাওয়ার সময় হয়নি, যার ফলে শরীর আর্দ্রতা হারায় এবং ত্বক শুষ্ক হয়ে যায়। ত্বককে সতেজ ও সুস্থ রাখতে প্রতিদিন কমপক্ষে ৮-১০ গ্লাস পানি পান করা জরুরি।
৪. ডায়েটের দিকে খেয়াল না রাখা
প্রতিদিনের খাবারে সঠিক পুষ্টি না থাকলে শরীরের অন্দরে সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। মা হওয়ার পর শাকসবজি, ফলমূল, প্রোটিন, এবং ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া উচিত। অস্বাস্থ্যকর খাবারের প্রতি আকর্ষণ বাড়ে, কিন্তু এই সময়টাতে খাবারের প্রতি মনোযোগী হওয়া শরীর ও ত্বকের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
৫. পর্যাপ্ত ঘুম না পাওয়া
শিশুর খেয়াল রাখতে গিয়ে মায়েরা অনেক সময় নিজেদের ঘুম ত্যাগ করেন, কিন্তু পর্যাপ্ত ঘুম না হলে শরীর ও ত্বক ধীরে ধীরে ক্লান্ত হয়ে যায়। ঘুম শরীরের পুনরুজ্জীবন ঘটায় এবং ত্বককে স্বাস্থ্যকর রাখে। মা হওয়ার পর ৭-৮ ঘণ্টা ঘুম পাওয়া খুবই জরুরি।
৬. স্ট্রেচ মার্কস উপেক্ষা করা
স্ট্রেচ মার্কস সাধারণত গর্ভাবস্থায় তৈরি হয়, কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে জন্মের পরও তারা থাকতে পারে। অনেক মায়েরা মনে করেন স্ট্রেচ মার্কসের বিরুদ্ধে কিছু করা সম্ভব নয়, কিন্তু নিয়মিত ময়েশ্চারাইজিং ও বিশেষ ক্রিমের ব্যবহার স্ট্রেচ মার্কসের দৃশ্যমানতা কমাতে সাহায্য করতে পারে। তবে, এটি ধৈর্য্য এবং নিয়মিত যত্নের ব্যাপার।
৭. শারীরিক ব্যায়ামের প্রতি উদাসীনতা
শরীরের স্বাভাবিক কার্যকলাপ ফিরিয়ে আনতে শারীরিক ব্যায়াম খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যদিও মা হওয়ার পর নতুন রুটিনে খুব বেশি সময় পাওয়া যায় না, তবে কিছু সোজা ব্যায়াম যেমন হাঁটা, যোগব্যায়াম বা পাইলেটস চেষ্টা করুন। এটি আপনার শরীরকে টোনড এবং শক্তিশালী রাখবে।
৮. মানসিক স্বাস্থ্যের অবহেলা
শরীর ও ত্বকের যত্ন নেওয়া যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি মানসিক স্বাস্থ্যের খেয়াল রাখা সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। মায়ের উপর অনেক চাপ থাকতে পারে, কিন্তু নিজের জন্য একটু সময় বের করে কিছু কাজ করুন যা আপনাকে শান্তি ও আনন্দ দেয়। আপনার মনকে সুস্থ রাখলে, শরীর ও ত্বকও স্বাস্থ্যকর থাকবে।
উপসংহার
সন্তান জন্মের পর নিজের ত্বক ও চুলের যত্ন নেওয়া কোনো বিলাসিতা নয়, বরং প্রয়োজন। ঘরোয়া পদ্ধতি এবং নিয়মিত যত্ন মেনে চললে খুব কম সময় ব্যয় করেও ত্বক এবং চুলের স্বাস্থ্য রক্ষা করা সম্ভব। মা সুস্থ থাকলেই সন্তানের যত্ন আরও ভালোভাবে নেওয়া যাবে।
মা হওয়ার পর শরীর ও ত্বকে কিছু পরিবর্তন দেখা দেওয়া স্বাভাবিক। এই পরিবর্তনগুলোকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিয়ে সঠিক যত্ন নিলে আপনার শরীর দ্রুতই আগের অবস্থায় ফিরে আসবে। নিজের যত্ন নেওয়ার পাশাপাশি আনন্দ উপভোগ করুন এবং আপনার শিশুর সঙ্গে সুন্দর সময় কাটান।নিজের যত্ন নিন এবং সুস্থ থাকুন!আপনার এই যাত্রা সুন্দর এবং স্বাস্থ্যকর হোক! 🌸আরো জানুন
গর্ভাবস্থায় শরীরের পরিবর্তন: কীভাবে নিজেকে সুস্থ রাখবেন?
শারীরিক পরিবর্তন ছাড়াও: গর্ভাবস্থায় মানসিক পরিবর্তন ও তাদের মোকাবিলা
গর্ভাবস্থায় মানসিক রোলারকোস্টার: কীভাবে সামলাবেন?
মা ও শিশুর অদৃশ্য বন্ধন: গর্ভাবস্থা থেকে শুরু
Postpartum Depression: কেন হয় এবং কীভাবে মোকাবিলা করবেন
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন