শিশুকে মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো শুধু একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া নয়, এটি মা ও শিশুর মধ্যে গভীর এক বন্ধন তৈরি করে। বুকের দুধ খাওয়ানো মায়ের স্বাস্থ্য এবং শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কিন্তু এই সহজাত প্রক্রিয়া নিয়ে অনেক প্রচলিত ভুল ধারণা আমাদের সমাজে প্রচলিত। এই ধারণাগুলো অনেক সময় মায়েদের মধ্যে বিভ্রান্তি ও হতাশার সৃষ্টি করে।
আজ আমরা এমন ১৪টি ভুল ধারণার আসল সত্য তুলে ধরব, যা মায়েদের বুকের দুধ খাওয়ানোর বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করবে।
১. ভুল ধারণা: শিশুকে মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো সহজ।
বাস্তবতা: শিশুরা মায়ের বুকের দুধ খাওয়ার প্রবৃত্তি নিয়ে জন্মালেও সঠিক পদ্ধতি রপ্ত করতে মা ও শিশুর সময় লাগে। মায়ের সাহায্যে শিশুকে সঠিক অবস্থানে এনে স্তনের সঙ্গে যুক্ত করাতে হয়। এজন্য মায়েদের স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের কাছ থেকে সহায়তা নেওয়া উচিত।
২. ভুল ধারণা: স্তনের বোঁটা ক্ষত হবেই।
বাস্তবতা: সঠিক অবস্থানে রেখে দুধ খাওয়ালে স্তনের বোঁটার ক্ষত এড়ানো সম্ভব। প্রথমদিকে কিছুটা অস্বস্তি হতে পারে, কিন্তু বিশেষজ্ঞের সাহায্যে এটি সহজেই কাটিয়ে উঠা যায়।
৩. ভুল ধারণা: দুধ খাওয়ানোর আগে স্তনের বোঁটা ধুতে হবে।
বাস্তবতা: স্তনের বোঁটায় প্রাকৃতিকভাবে এমন কিছু উপাদান থাকে, যা শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। অতিরিক্ত পরিষ্কার করলে এই উপকারী উপাদান নষ্ট হতে পারে। তাই দুধ খাওয়ানোর আগে বোঁটা ধোয়ার প্রয়োজন নেই।
৪. ভুল ধারণা: মায়ের বিশ্রামের জন্য শিশু ও মাকে আলাদা রাখা উচিত।
বাস্তবতা: মায়ের সঙ্গে ত্বকের সংস্পর্শে থাকা শিশুর জন্য উপকারী। এটি মায়ের দুধ খাওয়ার প্রবৃত্তি বাড়ায় এবং মায়ের সঙ্গে শিশুর বন্ধন আরও গভীর করে।
৫. ভুল ধারণা: দুধ খাওয়ানোর সময় মাকে বিশেষ খাবার খেতে হবে।
বাস্তবতা: মায়েদের সুষম খাদ্যই যথেষ্ট। অতিরিক্ত কোনো বিশেষ খাবার প্রয়োজন নেই। তবে কোনো খাবার শিশুর জন্য সমস্যা সৃষ্টি করলে শিশুর চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে।
৬. ভুল ধারণা: ব্যায়াম দুধের স্বাদ পাল্টে দেয়।
বাস্তবতা: ব্যায়াম করলে মায়ের শরীর সুস্থ থাকে। এটি দুধের স্বাদ বা পুষ্টিতে কোনো পরিবর্তন আনে না।
৭. ভুল ধারণা: জন্মের পরপর দুধ খাওয়ানো না গেলে পরে আর সম্ভব নয়।
বাস্তবতা: দেরি হলেও মায়ের ত্বকের সংস্পর্শ এবং সঠিক পদ্ধতিতে শিশুকে স্তনের কাছে আনলে দুধ খাওয়ানো সম্ভব। এজন্য মায়েদের আত্মবিশ্বাস রাখা গুরুত্বপূর্ণ।
৮. ভুল ধারণা: ফর্মুলা দিলে মায়ের দুধ বন্ধ হয়ে যাবে।
বাস্তবতা: ফর্মুলার প্রয়োগের ক্ষেত্রে সচেতন থাকা দরকার। বুকের দুধ তৈরি চালিয়ে রাখতে শিশুকে নিয়মিত বুকের দুধ খাওয়াতে হবে এবং বিশেষজ্ঞের সঙ্গে পরামর্শ করা উচিত।
৯. ভুল ধারণা: অনেক মায়েরই পর্যাপ্ত দুধ তৈরি হয় না।
বাস্তবতা: প্রায় সব মায়ের শরীরে প্রয়োজনীয় দুধ তৈরি হয়। তবে সঠিকভাবে শিশুকে দুধ খাওয়ানো এবং মায়ের পুষ্টি ও বিশ্রামের গুরুত্ব অপরিসীম।
১০. ভুল ধারণা: অসুস্থ মায়েরা দুধ খাওয়াতে পারবেন না।
বাস্তবতা: বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অসুস্থ মায়েরা দুধ খাওয়ানো চালিয়ে যেতে পারেন। তাদের চিকিৎসা ও বিশ্রামের বিষয়টি নিশ্চিত করা জরুরি।
১১. ভুল ধারণা: ওষুধ সেবন করলে দুধ খাওয়ানো বন্ধ করতে হবে।
বাস্তবতা: চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন করলে শিশুকে দুধ খাওয়ানো নিরাপদ। তবে মায়ের চিকিৎসক ও শিশুর চিকিৎসককে এ বিষয়ে জানাতে হবে।
১২. ভুল ধারণা: বুকের দুধ খাওয়ার শিশুরা মাকে বেশি আঁকড়ে ধরে।
বাস্তবতা: শিশুর ব্যক্তিত্বের সঙ্গে এর সম্পর্ক আছে। তবে বুকের দুধ খাওয়ানো শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশে সহায়তা করে।
১৩. ভুল ধারণা: এক বছরের বেশি হলে দুধ ছাড়ানো যায় না।
বাস্তবতা: দুই বছর পর্যন্ত শিশুকে দুধ খাওয়ানো স্বাস্থ্যকর। তবে মা ও শিশুর পরিস্থিতি অনুযায়ী এই সময় নির্ধারণ করা উচিত।
১৪. ভুল ধারণা: কাজে ফিরলে শিশুকে দুধ খাওয়ানো বন্ধ করতে হবে।
বাস্তবতা: কাজের সময় বুকের দুধ সংগ্রহ করে সংরক্ষণ করা সম্ভব। সুযোগ পেলে শিশুকে সরাসরি দুধ খাওয়ানো চালিয়ে যেতে পারেন।
উপসংহার:
শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোর বিষয়টি প্রাকৃতিক হলেও এটি নিয়ে সচেতনতা ও সঠিক তথ্য থাকা অত্যন্ত জরুরি। মায়ের দুধ শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই এসব ভুল ধারণা দূর করে মায়েদের আত্মবিশ্বাসী করা এবং প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দেওয়া আমাদের সবার দায়িত্ব।
আপনার যদি এ বিষয়ে আরও কোনো প্রশ্ন বা পরামর্শ থাকে, তবে তা আমাদের জানাতে পারেন। আমরা আপনার পাশে আছি।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন