শিশুর অতিরিক্ত কান্না: কারণ, প্রতিকার ও চিকিৎসা পরামর্শ

শিশুর কান্না একেবারে স্বাভাবিক ব্যাপার, কারণ এটি তার চাহিদা ও অস্বস্তি প্রকাশের প্রধান উপায়। তবে যখন কান্না অতিরিক্ত হয়ে যায় এবং নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়, তখন এটি মা-বাবার জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। শিশুর কান্নার কারণ বোঝা গেলে এবং যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হলে এটি অনেকাংশে কমানো সম্ভব। 

শিশুর অতিরিক্ত কান্না কারণ, প্রতিকার ও চিকিৎসা পরামর্শ

চলুন, এবার শিশুর অতিরিক্ত কান্নার কারণ, প্রতিকার এবং চিকিৎসা পরামর্শ সম্পর্কে বিস্তারিত জানি।

শিশুর অতিরিক্ত কান্নার কারণ

শিশুর অতিরিক্ত কান্নার পেছনে প্রধানত দুটি বড় কারণ থাকতে পারে— ফাংশনাল এবং অর্গানিক

১. ফাংশনাল কারণ

ফাংশনাল কারণে শিশুরা ৯৫% ক্ষেত্রে অতিরিক্ত কান্না করে। এতে গুরুতর শারীরিক কোনো সমস্যা থাকে না, বরং এটি সাধারণ কিছু কারণে ঘটে:

  • ক্ষুধা: শিশুরা যখন ক্ষুধার্ত হয়, তখন তারা কান্নার মাধ্যমে তা প্রকাশ করে।

  • অতিরিক্ত খাওয়া: অনেক সময় অতিরিক্ত খাওয়ার পর শিশুর পেটে অস্বস্তি বা গ্যাস জমে যায়, যা কান্নার কারণ হতে পারে।

  • ঘুম না আসা: শিশু যদি ঠিকমতো ঘুমাতে না পারে বা ক্লান্ত হয়, তাহলে কান্নাকাটি করে।

  • অস্বস্তি বা পরিবেশগত কারণ: গরম বা ঠান্ডা বেশি লাগলে, প্রস্রাব বা পায়খানা করে ফেললে শিশুর অস্বস্তি হয় এবং কান্না করে।

  • মনোযোগ আকর্ষণ: কোলে উঠতে চাওয়া, খেলতে না চাওয়া বা একাকিত্ব অনুভব করলেও শিশু কান্না করতে পারে।

  • অতিরিক্ত উত্তেজনা বা ক্লান্তি: অনেক সময় বেশি আলো, শব্দ বা খেলার কারণে শিশুর অতিরিক্ত উত্তেজনা দেখা যায় এবং সে কান্না করে।

২. ইনফ্যান্টাইল কোলিক

ইনফ্যান্টাইল কোলিক শিশুর অতিরিক্ত কান্নার একটি সাধারণ কারণ। সাধারণত ৬-৮ সপ্তাহ বয়সের মধ্যে এটি দেখা যায় এবং ৩ মাসের মধ্যে ধীরে ধীরে কমে যায়। যদি শিশু দিনে ৩ ঘণ্টার বেশি, সপ্তাহে ৩ দিনের বেশি এবং ৩ সপ্তাহ ধরে এভাবে কান্না করে, তবে এটি ইনফ্যান্টাইল কোলিক হতে পারে।

কারণসমূহ:

  • শিশুর অপরিপক্ব পাচনতন্ত্রের কারণে খাবার হজম করতে সমস্যা হয়।

  • দুধের (বিশেষ করে গরুর দুধ) প্রোটিনে অ্যালার্জি থাকলে কোলিক হতে পারে।

  • বুকের দুধ খাওয়ার সময় শিশুর পেটে বাতাস ঢুকে গ্যাস সৃষ্টি করতে পারে।

৩. অর্গানিক কারণ

শিশুর কান্নার ৫% ক্ষেত্রে এটি শারীরিক সমস্যার কারণে হয়ে থাকে। সাধারণ অর্গানিক কারণগুলো হলো:

  • জ্বর বা সংক্রমণ: ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার কারণে শিশুর জ্বর হলে সে কান্না করতে পারে।

  • কান ব্যথা: শিশুর কান লাল হয়ে গেলে বা পুঁজ পড়লে কান্না বাড়তে পারে।

  • নাক বন্ধ হওয়া: ঠান্ডা বা অ্যালার্জির কারণে শিশুর নাক বন্ধ থাকলে সে বিরক্ত হয়ে কাঁদতে পারে।

  • ডায়াপার র‌্যাশ: ডায়াপার ব্যবহারের কারণে ত্বকে র‌্যাশ বা ঘা হলে ব্যথার কারণে শিশু কাঁদতে পারে।

  • গলা ব্যথা: গলা ব্যথা থাকলে খাবার গিলতে সমস্যা হয়, ফলে শিশু কান্না করতে পারে।


শিশুর অতিরিক্ত কান্নার প্রতিকার

শিশুর কান্না কমানোর জন্য কিছু কার্যকরী উপায়:

১. শিশুর চাহিদা পূরণ করুন

  • ক্ষুধার কারণে কান্না করলে তাকে বুকের দুধ বা ফর্মুলা দুধ দিন।

  • শিশু যদি ক্লান্ত বা ঘুমানোর চেষ্টা করে, তবে শান্ত ও আরামদায়ক পরিবেশ তৈরি করুন।

  • ঠান্ডা বা গরম যাতে না লাগে, সে বিষয়টি নিশ্চিত করুন।

২. শিশুর পেটের সমস্যা নিরসন করুন

  • বুকের দুধ খাওয়ানোর সময় শিশুর যেন পর্যাপ্ত বাতাস বের হতে পারে, সেদিকে খেয়াল করুন।

  • খাওয়ানোর পর শিশুকে কিছুক্ষণ সোজা করে ধরে রাখুন যাতে হজম ভালো হয়।

  • পেটের ব্যথা হলে হালকা গরম পানির সেঁক দিতে পারেন।

৩. মনোযোগ ও ভালোবাসা দিন

  • শিশু যদি কোলে থাকতে চায়, তবে তাকে আদর করুন।

  • গান গেয়ে বা গল্প বলে শিশুকে শান্ত করার চেষ্টা করুন।

  • বেশি শব্দ ও আলো থেকে দূরে রাখুন।

৪. ইনফ্যান্টাইল কোলিকের প্রতিকার

  • শিশুকে খাওয়ানোর সময় ফাঁকা ফাঁকা বিরতি দিন যাতে অতিরিক্ত বাতাস না ঢোকে।

  • মায়ের খাদ্যতালিকা পরিবর্তন করে দেখা যেতে পারে (যদি বুকের দুধ খায়)।

  • বিশেষ ধরণের এন্টি-কলিক বোতল ব্যবহার করা যেতে পারে।

৫. ডায়াপার পরিবর্তন করুন ও ত্বকের যত্ন নিন

  • নিয়মিত ডায়াপার পরিবর্তন করুন এবং ত্বকের যত্ন নিন।

  • র‌্যাশ হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে নির্দিষ্ট ক্রিম ব্যবহার করুন।

শিশুর কান্না থামানোর উপায়

  • আরামদায়ক পরিবেশ নিশ্চিত করা

  • ক্ষুধার্ত হলে খাওয়ানো, তবে অতিরিক্ত নয়

  • কপাল, মাথা ও পিঠে হাত বুলিয়ে দেওয়া

  • কোলে দোলানো বা স্ট্রলারে করে ঘোরানো

  • কুসুম গরম পানি দিয়ে গোসল করানো

  • হালকা সংগীত শোনানো বা গান গেয়ে শান্ত করা

  • ঘরে হালকা আলো রাখা

  • ডায়াপার ভিজে গেলে বদলে দেওয়া


চিকিৎসা পরামর্শ

যদি শিশুর অতিরিক্ত কান্না দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং নিচের লক্ষণগুলো দেখা যায়, তবে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন:

  • জ্বর (১০০.৪°F বা তার বেশি)

  • খাবার খেতে সমস্যা বা গিলতে না পারা

  • অতিরিক্ত ল্যাথার্জিক বা অস্বাভাবিকভাবে নিস্তেজ থাকা

  • দীর্ঘস্থায়ী কান্না যা ৩ ঘণ্টার বেশি ধরে চলে

  • ডায়াপারে রক্তের চিহ্ন বা অতিরিক্ত পায়খানা

  • শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া বা অস্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাস

  • ধারাবাহিকভাবে ৩ ঘণ্টার বেশি কান্না করলে

  • শিশুর কান্না দেখে যদি ব্যথার অনুভূতি মনে হয়

  • কান্নার সঙ্গে জ্বর, বমি, ডায়রিয়া, বা খাবার গ্রহণে অনীহা থাকলে

  • কোনোভাবেই যদি কান্না থামানো না যায়

  • শিশুর কান্না নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই যদি তা স্বাভাবিক কারণগুলোর মধ্যে পড়ে। তবে উপরোক্ত লক্ষণগুলোর মধ্যে কোনোটি দেখা গেলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।

শিশুর স্বাস্থ্যের প্রতি সর্বদা যত্নশীল হওয়া উচিত এবং সন্দেহজনক কিছু মনে হলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।


উপসংহার

শিশুর কান্না তার প্রয়োজন ও অস্বস্তি প্রকাশের স্বাভাবিক মাধ্যম। তবে অতিরিক্ত কান্না হলে এর কারণ চিহ্নিত করে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এটি ফাংশনাল কারণে হয়ে থাকে এবং সঠিক যত্ন ও প্রতিকার নিলে কমে যায়। তবে যদি কোনো শারীরিক সমস্যা বা অর্গানিক কারণ থেকে থাকে, তবে দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

আরো জানুন

FAQs

১. নবজাতকের অতিরিক্ত কান্না কি স্বাভাবিক? 

হ্যাঁ, সাধারণত নবজাতকেরা দিনে ৩ ঘণ্টার মতো কাঁদতে পারে। তবে যদি এটি দীর্ঘস্থায়ী হয়, তবে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

২. ইনফ্যান্টাইল কোলিক কীভাবে চিহ্নিত করা যায়?

শিশু যদি বিকেলের দিকে নিয়মিত ৩ ঘণ্টার বেশি সময় কাঁদে এবং থামানো না যায়, তাহলে এটি ইনফ্যান্টাইল কোলিক হতে পারে।

৩. শিশুর কান্না কমানোর ঘরোয়া উপায় কী?

শিশুকে কোলে নেওয়া, হালকা দোল দেওয়া, গান শোনানো এবং আরামদায়ক পরিবেশ তৈরি করা সহায়ক হতে পারে।

৪. শিশুর কান্না কি খাদ্যজনিত কারণে হতে পারে? 

হ্যাঁ, কিছু শিশু দুধের প্রোটিনে সংবেদনশীল হতে পারে, যা পেটে গ্যাস বা অস্বস্তি তৈরি করে এবং কান্নার কারণ হতে পারে।

বিশেষ দ্রষ্টব্য

শিশুর কান্না সাধারণত স্বাভাবিক, তবে যদি কান্নার ধরনে অস্বাভাবিকতা দেখা যায় বা অন্য কোনো শারীরিক সমস্যা লক্ষ করা যায়, তাহলে অবশ্যই শিশু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত। শিশুকে কখনোই জোরে ঝাঁকানো উচিত নয়, কারণ এতে তার মস্তিষ্কের ক্ষতি হতে পারে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

[blogger]

যোগাযোগ ফর্ম

নাম

ইমেল *

বার্তা *

Blogger দ্বারা পরিচালিত.
Javascript DisablePlease Enable Javascript To See All Widget