নবজাতকের মুখের স্বাস্থ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তাদের প্রতিরোধ ক্ষমতা এখনও সম্পূর্ণ বিকশিত হয়নি। অনেক সময় দেখা যায়, নবজাতকের মুখের ভেতরে ছোট ছোট সাদা বা লালচে ঘা হয়, যা ব্যথার কারণ হতে পারে এবং খাওয়ার সময় অস্বস্তি সৃষ্টি করে। অনেক বাবা-মা এমন পরিস্থিতিতে দুশ্চিন্তায় পড়ে যান। তবে বেশিরভাগ মুখের ঘা তেমন গুরুতর হয় না এবং সহজ কিছু পরিচর্যার মাধ্যমেই নিরাময় সম্ভব।
এই ইনফোটিতে আমরা নবজাতকের মুখে ঘা হওয়ার কারণ, প্রতিরোধের উপায়, দ্রুত নিরাময় এবং কখন চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব।
নবজাতকের মুখে ঘা হওয়ার কারণ
নবজাতকের মুখে ঘা সাধারণত বিভিন্ন কারণে হতে পারে। এর মধ্যে সবচেয়ে সাধারণ কারণগুলো হলো—
১. ছত্রাক সংক্রমণ (ওরাল থ্রাশ)
🔹 নবজাতকের মুখে ঘা বা সাদা দাগের অন্যতম প্রধান কারণ হলো ক্যানডিডা অ্যালবিকানস (Candida Albicans) নামক এক প্রকার ছত্রাক সংক্রমণ, যা ওরাল থ্রাশ নামে পরিচিত।
🔹 এটি সাধারণত তখনই হয় যখন শিশুর মুখের ব্যাকটেরিয়া ও ফাঙ্গাসের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়।
২. ভাইরাস সংক্রমণ
🔹 কিছু ভাইরাস, বিশেষ করে হার্পিস সিমপ্লেক্স ভাইরাস (HSV), নবজাতকের মুখে ছোট ছোট ঘা সৃষ্টি করতে পারে।
🔹 এই ভাইরাস সংক্রমণের ফলে শিশুর মুখে লালচে ফুসকুড়ি বা ব্যথাযুক্ত ঘা দেখা দিতে পারে।
৩. অপুষ্টি ও দেহের দুর্বলতা
🔹 নবজাতকের শরীরে যদি পর্যাপ্ত ভিটামিন বি১২, আয়রন বা ফোলেটের ঘাটতি থাকে, তবে মুখের ভেতরে ছোট ছোট ঘা হতে পারে।
🔹 জন্মের পর যদি মায়ের বুকের দুধ পর্যাপ্ত পরিমাণে না পায়, তাহলে শিশুর পুষ্টির ঘাটতি হতে পারে, যা তার মুখের স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করতে পারে।
৪. আঘাতজনিত কারণে মুখে ঘা
🔹 নবজাতকরা অনেক সময় নিজের মুখে হাত দেয় বা ছোটখাটো আঘাত পায়, যা থেকে মুখে ঘা হতে পারে।
🔹 বোতলের নিপল বা শক্ত কিছু চুষতে গেলে মুখের ভেতরের নরম টিস্যুতে ক্ষত সৃষ্টি হতে পারে।
৫. অ্যালার্জি ও সংবেদনশীলতা
🔹 কিছু শিশুর ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট খাবার বা ফর্মুলা দুধে অ্যালার্জি দেখা যায়, যা মুখে ঘা সৃষ্টি করতে পারে।
🔹 মায়ের খাদ্যাভ্যাসের প্রভাবও শিশুর মুখের স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করতে পারে।
নবজাতকের জিহ্বায় ঘা পরিষ্কার করার উপায়
নবজাতকের জিহ্বায় ঘা হলে তা পরিষ্কার করতে বিশেষ যত্ন প্রয়োজন, কারণ তাদের ত্বক ও মুখের ভেতরের অংশ অত্যন্ত সংবেদনশীল। নিচে ধাপে ধাপে সঠিক পদ্ধতি দেওয়া হলো—
১. পরিষ্কার হাত ও সরঞ্জাম প্রস্তুত করুন
👐 প্রথমে ভালোভাবে হাত ধুয়ে নিন, যেন জীবাণু সংক্রমণ না হয়।
🧼 পরিষ্কার ও নরম কাপড় (গজ বা নরম তুলার কাপড়) অথবা তুলার বল ব্যবহার করুন।
💧 হালকা কুসুম গরম পানি অথবা লবণ-পানি (১ কাপ ফুটানো ঠান্ডা পানিতে ১/২ চা চামচ লবণ) তৈরি করুন।
২. নরম কাপড়ে গরম পানি বা লবণ-পানি ভিজিয়ে পরিষ্কার করুন
✔ নরম কাপড় বা গজ হালকা গরম পানিতে ভিজিয়ে নিন।
✔ খুব আস্তে আস্তে শিশুর জিহ্বার উপর মুছুন, যেন ব্যথা না পায়।
✔ দিনে ২-৩ বার এটি করতে পারেন, বিশেষ করে খাওয়ানোর পর।
৩. বেকিং সোডা মিশ্রিত পানি ব্যবহার করুন (ওরাল থ্রাশ থাকলে)
👶 ওরাল থ্রাশ (সাদা দাগ) থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ১ কাপ কুসুম গরম পানিতে ১/২ চা চামচ বেকিং সোডা মিশিয়ে নিন।
🔹 গজ বা তুলা এতে ভিজিয়ে শিশুর জিহ্বা ধীরে ধীরে মুছুন।
🔹 এটি সংক্রমণ কমাতে সাহায্য করবে।
৪. নারকেল তেল বা অলিভ অয়েল ব্যবহার করুন (প্রাকৃতিক প্রতিকার)
🥥 এক ফোঁটা বিশুদ্ধ নারকেল তেল বা অলিভ অয়েল আঙুলে নিয়ে জিহ্বায় আলতোভাবে লাগান।
💡 এটি সংক্রমণ কমাতে এবং ব্যথা উপশমে সাহায্য করবে।
৫. মায়ের স্তন ও ফিডার পরিষ্কার রাখুন
👩🍼 স্তন্যপান করানোর আগে মায়ের স্তন পরিষ্কার করা জরুরি, বিশেষ করে যদি শিশুর মুখে ছত্রাকজনিত সংক্রমণ থাকে।
🍼 যদি বোতল বা পেসিফায়ার ব্যবহার করেন, তাহলে প্রতিবার গরম পানিতে ভালোভাবে ধুয়ে নিন।
নবজাতকের মুখে ঘা প্রতিরোধের উপায়
নবজাতকের মুখে ঘা প্রতিরোধের জন্য কিছু সাধারণ নিয়ম মেনে চলা প্রয়োজন—
১. শিশুর মুখ পরিষ্কার রাখুন
🧼 প্রতিবার খাওয়ানোর পর শিশুর মুখ পরিষ্কার করুন, যাতে ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাক জমতে না পারে।
🍼 বোতল, নিপল, চুষনি (Pacifier) ইত্যাদি ভালোভাবে জীবাণুমুক্ত করুন।
২. মায়ের পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখুন
👩🍼 স্তন্যপান করানোর আগে এবং পরে স্তনের পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করুন।
🛑 যদি স্তনে ছত্রাক সংক্রমণ (থ্রাশ) থাকে, তাহলে দ্রুত চিকিৎসা নিন, কারণ এটি শিশুর মুখেও সংক্রমিত হতে পারে।
৩. শিশুর পুষ্টির প্রতি খেয়াল রাখুন
🥛 শিশুর পর্যাপ্ত বুকের দুধ নিশ্চিত করুন, কারণ এটি প্রাকৃতিকভাবে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
🥦 মায়ের খাদ্যাভ্যাস সুষম হওয়া উচিত, যাতে শিশুর দেহ প্রয়োজনীয় পুষ্টি পায়।
৪. ধীরে ধীরে খাওয়ান এবং নরম নিপল ব্যবহার করুন
🚼 শিশুকে বোতল থেকে খাওয়ানোর সময় ধীরে ধীরে খাওয়ান, যাতে মুখে আঘাত না লাগে।
🍼 অতিরিক্ত শক্ত বা রুক্ষ বোতলের নিপল ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন।
৫. অ্যালার্জিজনিত খাবার এড়িয়ে চলুন
🥜 মায়ের খাওয়া কিছু খাবার (যেমন- গরুর দুধ, বাদাম, চিংড়ি) শিশুর মুখে সংবেদনশীলতা সৃষ্টি করতে পারে। যদি অ্যালার্জির লক্ষণ দেখা যায়, তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
নবজাতকের মুখে ঘা হলে দ্রুত নিরাময়ের উপায়
যদি নবজাতকের মুখে ঘা হয়, তবে নিচের কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে—
১. ওরাল থ্রাশ হলে করণীয়
✅ মৃদু বেকিং সোডা মিশ্রিত পানি দিয়ে শিশুর মুখ মুছে দিন (চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী)।
✅ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী অ্যান্টিফাঙ্গাল ওষুধ (যেমন- নিস্টাটিন বা ফ্লুকোনাজল) ব্যবহার করুন।
২. মুখে ব্যথা কমানোর জন্য ঘরোয়া উপায়
🥥 নারকেল তেল: এটি ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাক প্রতিরোধে সহায়ক এবং ব্যথা কমাতে সাহায্য করে।
🍯 মধু (৬ মাসের বেশি বয়স হলে): মধুতে প্রাকৃতিক অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল উপাদান রয়েছে, যা মুখের ঘা নিরাময়ে সহায়ক।
৩. চিকিৎসা প্রয়োজন হলে কী করবেন?
⚕️ যদি নবজাতকের মুখের ঘা বেশি দিন স্থায়ী হয় বা খাওয়াদাওয়া করতে কষ্ট হয়, তবে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
💊 চিকিৎসক অ্যান্টিবায়োটিক, অ্যান্টিফাঙ্গাল বা ব্যথানাশক ওষুধ দিতে পারেন, যা সংক্রমণ দ্রুত সারিয়ে তুলতে সাহায্য করবে।
কখন চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে?
নিচের উপসর্গগুলো দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত—
🚨 শিশুর মুখের ঘা এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে থাকলে।
🚨 খাওয়ার সময় শিশু বারবার কান্না করলে বা খেতে অস্বীকৃতি জানালে।
🚨 শিশুর জ্বর, ক্লান্তি বা শরীরে ফুসকুড়ি দেখা দিলে।
🚨 মুখের ঘা ফাটতে শুরু করলে বা রক্তক্ষরণ হলে।
শেষ কথা
নবজাতকের মুখের ঘা বেশিরভাগ সময় গুরুতর সমস্যা নয়, তবে এটি শিশু এবং বাবা-মায়ের জন্য দুশ্চিন্তার কারণ হতে পারে। তাই আগেভাগে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা গুরুত্বপূর্ণ। যদি ঘা দীর্ঘস্থায়ী হয় বা শিশুর স্বাভাবিক খাওয়াদাওয়া ব্যাহত হয়, তবে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
আপনার নবজাতকের মুখের স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য এই গাইডটি সহায়ক হলে আমাদের জানান! 😊💙
আরো জেনে নিন
বাইনোকুলার ইনডাইরেক্ট অপথালমোস্কোপ কি? কারা কিভাবে কেন এটি ব্যবহার করবেন?
প্রথম ছয় মাস: স্তন্যপান, মানসিক বিকাশ ও সামাজিক দক্ষতা
শিশুর বিকাশের সোনালি সময়: শারীরিক দক্ষতা, সৃজনশীলতা ও বন্ধুত্বের পথচলা ও আনন্দময় যাত্রা
FAQs
১. নবজাতকের মুখে ঘা কতদিনে ভালো হয়?
✅ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নবজাতকের মুখের ঘা ৭-১০ দিনের মধ্যে সেরে যায়। তবে সংক্রমণের ধরন ও শিশুর প্রতিরোধ ক্ষমতার ওপর নির্ভর করে এটি দ্রুত বা দেরিতে নিরাময় হতে পারে।
২. নবজাতকের মুখে ঘা হলে কীভাবে বুঝবো?
👶 লক্ষণগুলো হলো—
🔹 জিহ্বা, মাড়ি বা ঠোঁটের ভেতরে সাদা বা লালচে ছোট দাগ।
🔹 খাওয়ার সময় অস্বস্তি বা কান্না করা।
🔹 মুখে লালচে বা ফুলে যাওয়া অংশ।
🔹 অতিরিক্ত লালা বের হওয়া।
৩. নবজাতকের মুখে ঘা হলে কী খাওয়ানো উচিত?
🍼 শুধুমাত্র মায়ের দুধই নবজাতকের জন্য সবচেয়ে ভালো খাবার।
💧 যদি মুখের ঘা থাকায় খাওয়াতে সমস্যা হয়, তবে ধীরে ধীরে খাওয়ান এবং প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
৪. নবজাতকের মুখের ঘা কি ছোঁয়াচে হতে পারে?
🦠 যদি এটি ছত্রাক বা ভাইরাসজনিত হয় (যেমন- ওরাল থ্রাশ বা হার্পিস), তবে এটি মায়ের স্তন বা অন্যান্য শিশুদের মাধ্যমে সংক্রমিত হতে পারে।
৫. মুখের ঘা পরিষ্কারের জন্য কি নিয়মিত লবণ-পানি ব্যবহার করা যাবে?
💧 হালকা লবণ-পানি বা বেকিং সোডা মিশ্রিত পানি চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবহার করা যায়, তবে অতিরিক্ত ব্যবহার শিশুর মুখে জ্বালাপোড়া সৃষ্টি করতে পারে।
৬. ওরাল থ্রাশ হলে ঘরোয়া উপায়ে কীভাবে নিরাময় করা যায়?
🥥 নারকেল তেল লাগানো বা বেকিং সোডা মিশ্রিত পানি দিয়ে মুছতে পারেন।
⚕️ তবে দীর্ঘস্থায়ী হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
৭. মুখে ঘা থাকলে কি নবজাতককে ফিডার দেওয়া যাবে?
🍼 ভালোভাবে জীবাণুমুক্ত করা বোতল ব্যবহার করা যেতে পারে, তবে মুখে ব্যথা থাকলে বোতল ব্যবহার না করে চামচ বা সিরিঞ্জ ফিডিং করতে পারেন।
৮. নবজাতকের মুখের ঘা হলে কখন চিকিৎসকের কাছে যাবেন?
🚨 যদি মুখের ঘা এক সপ্তাহের বেশি থাকে।
🚨 যদি শিশু খেতে না পারে বা বারবার কান্না করে।
🚨 যদি মুখের ঘা থেকে রক্তপাত হয় বা ফোলা দেখা যায়।
🚨 যদি শিশুর জ্বর আসে বা সংক্রমণের লক্ষণ দেখা দেয়।
এগুলো মেনে চললে নবজাতকের মুখের ঘা দ্রুত নিরাময় করা এবং প্রতিরোধ করা সহজ হবে। 😊💙
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন