📌 গালি দেওয়া একটি মারাত্মক অপরাধ
ইসলাম শান্তির ধর্ম। এটি শুধু ইবাদত-বন্দেগির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে উত্তম চরিত্র, সুন্দর আচার-আচরণ ও শালীন ভাষার শিক্ষা দেয়। গালি দেওয়া, কটু কথা বলা, অন্যকে কষ্ট দেওয়া ইসলাম সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেছে। কারণ, একজন মুমিন কখনো অশ্লীল ভাষায় কথা বলতে বা কাউকে কটূক্তি করতে পারে না।
বর্তমানে মানুষের মধ্যে গালি দেওয়ার প্রবণতা ভয়াবহভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। অনেকে ক্ষোভ, রাগ কিংবা ঠাট্টা-মশকরা করেও গালাগালি করে থাকেন। অথচ এটি শুধু নিন্দনীয় নয়, বরং ইসলাম এটিকে হারাম ঘোষণা করেছে।
📌 গালি দেওয়ার কুরআনি নিষেধাজ্ঞা
আল্লাহ তাআলা বলেন:
🔹 "যারা বিনা অপরাধে ঈমানদার পুরুষ ও নারীদের কষ্ট দেয়, তারা অবশ্যই মিথ্যা অপবাদ এবং স্পষ্ট অপরাধের বোঝা বহন করে।"
📖 (সুরা আহজাব, আয়াত: ৫৮)
এ আয়াত থেকে বোঝা যায়, যদি কেউ কাউকে কষ্ট দেয়, তবে সে মারাত্মক অপরাধের মধ্যে নিপতিত হয়। গালি দেওয়ার মাধ্যমে একজন মানুষ মানসিকভাবে আহত হয় এবং এটি সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে।
📌 গালি দেওয়া মুনাফিকদের অভ্যাস
রাসুলুল্লাহ (সা.) চারটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছেন, যা কারও মধ্যে থাকলে সে মুনাফিক হিসেবে পরিগণিত হবে। সেগুলো হলো—
✅ বিশ্বাস ভঙ্গ করা
✅ মিথ্যা কথা বলা
✅ অঙ্গীকার ভঙ্গ করা
✅ বিবাদে অন্যায় আচরণ করা
📖 (সহিহ বুখারি: ৩৪, সহিহ মুসলিম: ১০৬)
বিবাদ বা ঝগড়ার সময় অনেকে রাগের মাথায় গালিগালাজ করে থাকেন, যা সরাসরি মুনাফিকদের স্বভাবের অন্তর্ভুক্ত। তাই গালি দেওয়া থেকে অবশ্যই বিরত থাকা উচিত।
📌 রাসুল (সা.) এর সতর্কবাণী
🔹 "মুমিন ব্যক্তি কারো সম্মানে আঘাত করে না, কাউকে অভিশাপ দেয় না, অশ্লীল কাজ করে না এবং মন্দ কথা বলে না।"
📖 (তিরমিজি: ২১০৫)
🔹 "মুসলিমকে গালি দেওয়া ফাসেকি (পাপাচার) এবং তার সঙ্গে লড়াই করা কুফরি।"
📖 (বুখারি: ৬০৪৫, তিরমিজি: ১৯৮৩)
🔹 "যে ব্যক্তি কাউকে গালি দেয়, আর তার মধ্যে সে দোষ নেই, তাহলে গালির পাপ গালিদাতার উপর বর্তাবে।"
📖 (সহিহুল জামে: ৫৯৪)
📌 গালি দেওয়া কবিরা গুনাহ (মহাপাপ)
🔹 রাসুল (সা.) বলেছেন: "কবিরা গুনাহগুলোর একটি হলো নিজের বাবা-মাকে অভিশাপ করা।"
📖 (বুখারি: ৫৯৭৩, তিরমিজি: ১৯০২)
🛑 কেউ যখন অন্যের বাবা-মাকে গালি দেয়, তখন সেই ব্যক্তি পাল্টা গালি দিয়ে তার বাবা-মাকে অপমান করে। ফলে সে নিজেই নিজের পিতা-মাতাকে গালি দেওয়ার গুনাহের ভাগী হয়।
📌 গালির বদলে করণীয় কী?
✅ রাগ সংবরণ করা:
রাসুল (সা.) বলেছেন:
🔹 "শক্তিশালী ব্যক্তি সে নয়, যে কুস্তিতে অন্যকে পরাজিত করতে পারে; বরং প্রকৃত শক্তিশালী সে, যে রাগের সময় নিজেকে সংযত রাখতে পারে।"
📖 (বুখারি: ৬১১৪, মুসলিম: ২৬০৯)
✅ ধৈর্য ধারণ করা:
🔹 আল্লাহ তাআলা বলেন:
"যারা ক্রোধ দমন করে এবং মানুষের প্রতি ক্ষমাশীল— আল্লাহ তাদের ভালোবাসেন।"
📖 (সুরা আলে ইমরান: ১৩৪)
✅ শান্তভাবে কথা বলা:
🔹 "তোমরা মানুষের সাথে উত্তম ভাষায় কথা বলো।"
📖 (সুরা বাকারা: ৮৩)
✅ গালির জবাবে নীরব থাকা:
🔹 রাসুল (সা.) বলেছেন:
"যখন কেউ তোমাকে গালি দেয়, তখন তাকে পাল্টা গালি দিও না। বরং ধৈর্য ধরো, এতে তুমি পুণ্য লাভ করবে আর সে পাপের বোঝা বহন করবে।"
📖 (ইবনে হিব্বান: ৫২১)
📌 গালি থেকে বাঁচার দোয়া
যারা গালাগালি করার বদ-অভ্যাসে আক্রান্ত, তারা এই দোয়াটি বেশি বেশি পড়তে পারেন:
🔹 দোয়া:
📖 أَعُوذُ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ
উচ্চারণ: আউযুবিল্লাহি মিনাশ শাইতানির রাজীম
অর্থ: আমি বিতাড়িত শয়তান থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাই।
📖 (সুরা নাহল: ৯৮)
যদি কেউ রাগ বা গালির প্রবণতা অনুভব করে, তাহলে এই দোয়া পড়লে মন শান্ত হবে, এবং শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে।
🔹 গালি দেওয়া ইসলামে সম্পূর্ণ হারাম
ইসলাম আমাদের শিষ্টাচার, ভালো আচার-ব্যবহার এবং সুন্দর ভাষা ব্যবহারের শিক্ষা দেয়। গালি দেওয়া শুধু দুনিয়াতে নয়, বরং মৃত্যুর পরও ভয়াবহ শাস্তির কারণ হতে পারে।
✅ গালি দেওয়া হারাম ও কবিরা গুনাহ
✅ গালি দেওয়া মুনাফিকদের অভ্যাস
✅ গালি দিলে দুনিয়া, কবর ও আখিরাতে কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে
আসুন, কুরআন ও হাদিস থেকে বিস্তারিত জানি।
📌 গালি দিলে কবরের শাস্তি হবে?
হ্যাঁ, গালি দেওয়া একটি গুরুতর গুনাহ, যা কবরের শাস্তির কারণ হতে পারে।
🔹 রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
"মুমিনকে গালি দেওয়া ফাসেকি (পাপাচার), আর তাকে হত্যা করা কুফরি।"
📖 (বুখারি: ৬০৪৫, তিরমিজি: ১৯৮৩)
🔹 রাসুল (সা.) আরও বলেছেন:
"যে ব্যক্তি গালিগালাজ করে, কেয়ামতের দিন তার মুখমণ্ডল আগুনে পোড়ানো হবে।"
📖 (মুসনাদে আহমদ: ৮৭৮২)
🔹 অন্য এক হাদিসে এসেছে:
"গালি দেওয়া মানুষের অন্তরে বিদ্বেষ ছড়ায়, এবং কেয়ামতের দিন গালিদাতার আমলনামা গুনাহে পরিপূর্ণ থাকবে।"
📖 (তিরমিজি: ১৯৮৩)
এ থেকে বোঝা যায়, গালাগালি করলে শুধু দুনিয়ায় নয়, বরং কবরেও শাস্তি হবে এবং আখিরাতে ভয়ংকর পরিণতি ভোগ করতে হবে।
📌 গালি দেওয়া ও কবরের আজাব: কিছু হাদিস
🔹 কবরে কঠিন শাস্তির অন্যতম কারণ গালাগালি করা।
একবার রাসুল (সা.) দু’টি কবরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, তিনি বললেন:
"এই দুইজনকে কঠিন শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। তাদের একজন পেশাব থেকে বেঁচে থাকত না (শরীরে পেশাব লাগাতো), আর অন্যজন মানুষের মধ্যে গীবত করত (কটূ কথা ও গালাগালি করত)।"
📖 (বুখারি: ২১৮, মুসলিম: ২৯২)
🔹 অন্য এক হাদিসে এসেছে:
"যে ব্যক্তি মানুষের ইজ্জত নষ্ট করে (গালিগালাজ, গীবত, অপবাদ), তার জন্য কবর হবে জাহান্নামের একটি গর্ত।"
📖 (তিরমিজি: ২৪১৪)
📌 কবরের শাস্তির ভয়াবহতা (কুরআন ও হাদিসের আলোকে)
১. কবর আগুনের গর্তে পরিণত হবে
🔹 আল্লাহ বলেন:
"আমরা তাদের কঠিন আজাব দেবো এবং তাদের কবর জাহান্নামের এক গর্ত বানিয়ে দেবো।"
📖 (সুরা আনফাল: ৫০-৫১)
২. কবরে সাপ-বিচ্ছুর শাস্তি
🔹 হাদিসে এসেছে:
"যে ব্যক্তি গালি দেয়, অপবাদ দেয় এবং মানুষের হক নষ্ট করে, তার কবরের মধ্যে ৯৯টি বিষধর সাপ থাকবে, যেগুলো তাকে অনবরত দংশন করবে কেয়ামত পর্যন্ত।"
📖 (তাবরানি: ৫৬৭১)
৩. কবর সংকুচিত হয়ে যাবে
🔹 রাসুল (সা.) বলেছেন:
"যে ব্যক্তি খারাপ চরিত্রের অধিকারী (যেমন—গালাগালি করা, মানুষের সঙ্গে খারাপ আচরণ করা), তার কবর এমনভাবে সংকুচিত করা হবে যে তার পাঁজরের হাড় একে অপরের ভেতর ঢুকে যাবে।"
📖 (মুসনাদে আহমদ: ৪৪০৫)
৪. গালিদাতার কবর থেকে আগুন বের হবে
🔹 হাদিসে এসেছে:
"যে ব্যক্তি মানুষকে কষ্ট দেয়, গালি দেয়, তার কবর থেকে আগুন বের হতে থাকবে, যা তাকে জ্বালাতে থাকবে।"
📖 (বায়হাকী: ৮৩৬২)
📌 গালি দেওয়া থেকে বাঁচার উপায়
গালি দেওয়া থেকে বাঁচতে কুরআন ও হাদিসে কিছু নির্দেশনা রয়েছে:
✅ ১. রাগ নিয়ন্ত্রণ করা
🔹 রাসুল (সা.) বলেছেন:
"শক্তিশালী সে নয়, যে কুস্তিতে জয়ী হয়, বরং প্রকৃত শক্তিশালী সেই ব্যক্তি, যে রাগের সময় নিজেকে সংযত রাখতে পারে।"
📖 (বুখারি: ৬১১৪, মুসলিম: ২৬০৯)
✅ ২. নীরব থাকা
🔹 রাসুল (সা.) বলেছেন:
"যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান রাখে, সে যেন ভালো কথা বলে অথবা চুপ থাকে।"
📖 (বুখারি: ৬০১৮, মুসলিম: ৪৭)*
✅ ৩. উত্তম আচরণ করা
🔹 রাসুল (সা.) বলেছেন:
"তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম সে, যার আচরণ উত্তম।"
📖 (তিরমিজি: ১১৬২)
✅ ৪. গালির বদলে দোয়া করা
যদি কেউ গালি দেয়, তাহলে গালির বদলে দোয়া করা উত্তম। আল্লাহ তাআলা বলেন:
🔹 *"যখন তারা মূর্খদের (অশালীন ভাষায়) কথা বলতে শোনে, তখন তারা বলে, ‘আমাদের জন্য রয়েছে শান্তি’।"
📖 (সুরা ফুরকান: ৬৩)
🔹 রাসুল (সা.) বলেছেন:
"যখন কেউ তোমাকে গালি দেয়, তুমি পাল্টা গালি দিয়ো না। বরং বলো, ‘আমি আল্লাহর উপর ভরসা করি’।"
📖 (তিরমিজি: ২৪১৩)
📌 উপসংহার
ইসলামে গালি দেওয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ এবং এটি ফাসেকির লক্ষণ। গালি দেওয়া শুধুমাত্র ব্যক্তি নয়, বরং সমাজেও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। তাই একজন মুসলিম হিসেবে আমাদের উচিত সব সময় শালীন ও মার্জিত ভাষায় কথা বলা এবং ধৈর্য ধারণ করা।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে উত্তম চরিত্র গঠনের তাওফিক দান করুন এবং গালি দেওয়া থেকে বিরত রাখুন। আমিন। 🤲
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন