শিশুর কৃমি: লক্ষণ, কারণ ও প্রতিরোধের উপায়

শিশুর কৃমি একটি সাধারণ স্বাস্থ্য সমস্যা, যা তার শারীরিক বৃদ্ধি ও পুষ্টির অভাবে প্রভাব ফেলতে পারে। বাংলাদেশে ১০ বছরের নিচের শিশুদের মধ্যে কৃমির সংক্রমণ বেশি দেখা যায়। 

শিশুর কৃমি লক্ষণ, কারণ ও প্রতিরোধের উপায়

শিশুর কৃমি কেন হয়, কীভাবে বুঝবেন ও প্রতিরোধের উপায় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।


কৃমি কী ও কেন হয়?

কৃমি এক ধরনের পরজীবী, যা মানুষের অন্ত্রে বংশবিস্তার করে এবং শরীর থেকে পুষ্টি শোষণ করে। কৃমির সংক্রমণ হলে শিশুর খাওয়ার রুচি কমে যায়, শরীর ফ্যাকাশে হয়ে যায় এবং নানা ধরনের শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। কিছু কৃমি রক্ত শুষে নেয়, যা রক্তস্বল্পতার কারণ হতে পারে।

কৃমি সাধারণত খাদ্যনালীর নিচের অংশে থাকে, তবে কিছু ক্ষেত্রে লিভারেও সংক্রমণ হতে পারে, যা জন্ডিসের কারণ হতে পারে।


কৃমির সংক্রমণের কারণ

শিশুর কৃমির সংক্রমণের পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে, যেমন:

  1. পরিচ্ছন্নতার অভাব: অপরিষ্কার হাত, নখ ও কাপড়ের মাধ্যমে কৃমির ডিম শরীরে প্রবেশ করতে পারে।
  2. খালি পায়ে হাঁটা: বিশেষ করে মাটিতে বসবাসকারী কিছু কৃমি পায়ের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করতে পারে।
  3. অপরিষ্কার খাবার ও পানি: রাস্তার খাবার, দূষিত পানি বা অপরিষ্কারভাবে রান্না করা খাবার থেকে সংক্রমণ ছড়ায়।
  4. ধুলাবালি ও ময়লা: শিশুরা খেলাধুলার সময় হাত মুখে দিলে কৃমির সংক্রমণ হতে পারে।
  5. টয়লেট ব্যবহারের পর হাত না ধোয়া: এটি কৃমি ছড়ানোর অন্যতম প্রধান কারণ।
  6. পরিবারের অন্য কারও সংক্রমণ: একজন আক্রান্ত হলে পরিবারের অন্য সদস্যদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়তে পারে।

কৃমি সংক্রমণ প্রতিরোধে করণীয়

শিশুর কৃমি সংক্রমণ প্রতিরোধ করা সম্ভব যদি কিছু নিয়ম মেনে চলা যায়। এতে শিশু সুস্থ থাকতে পারে এবং কৃমির কারণে শারীরিক সমস্যা এড়ানো সম্ভব হয়। প্রতিরোধে যা যা করা প্রয়োজন:
  1. নিয়মিত হাত ধোয়া: মাটিতে খেলা বা বাইরে থেকে এসে অবশ্যই শিশুদের হাত ভালো করে সাবান দিয়ে ধুয়ে নেওয়া উচিত। এই অভ্যাসটি কৃমি সংক্রমণ প্রতিরোধে অনেকটা কার্যকর।

  2. সঠিকভাবে খাবার রান্না ও সংরক্ষণ: কৃমি সংক্রমণ এড়াতে শিশুদের সবসময় পরিষ্কার ও ভালোভাবে রান্না করা খাবার খাওয়ানো উচিত।

  3. পানির উৎস নিরাপদ রাখা: কৃমি সংক্রমণ প্রতিরোধে নিরাপদ পানির ব্যবস্থা নিশ্চিত করা জরুরি। শিশুকে সবসময় বিশুদ্ধ পানি পান করানোর চেষ্টা করুন।

  4. মাটি ও ময়লা থেকে দূরে রাখা: শিশুদের সবসময় মাটি বা ময়লা স্পর্শ করা থেকে দূরে রাখা এবং মাটি লাগানোর পর হাত ভালোভাবে ধুয়ে নেওয়া উচিত।

  5. ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা: শিশুদের নিয়মিত স্নান করানো, পরিষ্কার জামা পরানো, নখ ছোট রাখা এবং ময়লা থেকে দূরে রাখার মাধ্যমে কৃমি প্রতিরোধ করা সম্ভব।

কৃমি সংক্রমণ হলে করণীয়

যদি লক্ষণ দেখে বোঝা যায় যে শিশুর কৃমি হয়েছে, তবে চিকিৎসকের পরামর্শে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। কিছু করণীয়:

  1. চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী কৃমির ওষুধ খাওয়ানো: কৃমির জন্য সাধারণত ডিওয়ার্মিং ট্যাবলেট দেওয়া হয়। শিশুর বয়স অনুযায়ী ডোজ ঠিক করে চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ খাওয়ানো উচিত।

  2. খাবারে পুষ্টি নিশ্চিত করা: সংক্রমণ থেকে সুস্থ হওয়ার জন্য শিশুর খাবারে প্রোটিন, ভিটামিন ও মিনারেলসমৃদ্ধ খাবার রাখুন, যা তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।

  3. পর্যাপ্ত বিশ্রাম ও ঘুম: সংক্রমণের সময় শিশুকে পর্যাপ্ত বিশ্রাম ও ঘুমের সুযোগ দিন, যা তার শরীরকে দ্রুত সুস্থ হতে সহায়তা করবে।

  4. পর্যবেক্ষণ করা: চিকিৎসার পরেও যদি কৃমির লক্ষণ থেকে যায়, তবে চিকিৎসকের পরামর্শে পুনরায় পরীক্ষা করানো প্রয়োজন


শিশুর কৃমি হয়েছে কীভাবে বুঝবেন?

শিশুর কৃমি হলে নিম্নলিখিত লক্ষণগুলো দেখা দিতে পারে:

  1. খাবারে অরুচি: শিশু খেতে চায় না বা খুব কম খায়।
  2. পেট ফোলা ও বদহজম: শিশুর পেট ফুলে থাকতে পারে এবং মাঝে মাঝে পেটে ব্যথা হতে পারে।
  3. বারবার পাতলা পায়খানা: ঘন ঘন ডায়েরিয়া বা অপুষ্টিজনিত সমস্যা হতে পারে।
  4. শরীর ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া: রক্তশূন্যতা বা অ্যানিমিয়ার কারণে শিশুর ত্বকের উজ্জ্বলতা কমে যায়।
  5. বমি ভাব বা বমি হওয়া: শিশুর হজম সমস্যা ও বমি হওয়ার প্রবণতা দেখা দেয়।
  6. মলদ্বারে চুলকানি: বিশেষ করে রাতে ঘুমের মধ্যে শিশু যদি অতিরিক্ত চুলকায়, তবে এটি কৃমির লক্ষণ হতে পারে।
  7. মলের সাথে কৃমি দেখা যাওয়া: কিছু ক্ষেত্রে শিশুর মলে ছোট সাদা বা লম্বা কৃমি দেখা যেতে পারে।
  8. ত্বকে অ্যালার্জির সমস্যা: কিছু কৃমির সংক্রমণে শিশুর ত্বকে চুলকানি বা র‍্যাশ হতে পারে।

৫ লক্ষণে বুঝবেন শিশুর কৃমি হয়েছে

১️⃣ ঘন ঘন পেটে ব্যথা ও খিদে কম পাওয়া

  • শিশুর খাওয়ার ইচ্ছা কমে যায় বা ঠিকমতো খেতে চায় না।
  • অনেক সময় খাবার খাওয়ার পরও পেট ব্যথা হতে পারে।

2️⃣ খাবার খেলে পেটে ব্যথা হওয়া

  • খাওয়ার পরপরই যদি শিশু পেটের ব্যথায় কষ্ট পায়, তাহলে এটি কৃমির লক্ষণ হতে পারে।
  • এক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।

3️⃣ অস্বাভাবিক আচরণ (থুতু ফেলা, কামড়ানো, খিমচানো)

  • কিছু শিশু বারবার থুতু ফেলতে বা ছিটাতে থাকে।
  • অতিরিক্ত রাগ বা বিরক্তি প্রকাশ করে, কামড়ানো বা খিমচে দেওয়া শুরু করে।
  • এসব লক্ষণ কৃমির সংক্রমণ বেশি হলে দেখা দিতে পারে।

4️⃣ মলত্যাগের সময় কৃমি বেরিয়ে আসা

  • কিছু ক্ষেত্রে শিশুর মলের সঙ্গে ছোট সাদা বা লম্বা কৃমি বের হতে পারে।
  • এটি কৃমি সংক্রমণের নিশ্চিত লক্ষণ।

5️⃣ পায়ুদ্বারে চুলকানি ও অস্বস্তি

  • শিশুর পায়ুদ্বারে চুলকানি হলে তা কৃমির কারণে হতে পারে।
  • এটি সাধারণত রাতে বেশি হয়ে থাকে।

শিশুর কৃমি নিশ্চিত করতে পরীক্ষা

স্টুল (মল) পরীক্ষা:

  • শিশুর মলে কৃমি আছে কি না, তা দেখার জন্য স্টুল পরীক্ষা করা যেতে পারে।
  • পরপর তিন দিন পরীক্ষা করালে নির্ভুল ফলাফল পাওয়া সম্ভব।

যদি পরীক্ষায় কৃমি না ধরা পড়ে, তবুও লক্ষণ থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

কৃমির চিকিৎসা

✅ কৃমি হলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

✅ কৃমিনাশক ওষুধের নির্দিষ্ট ডোজ ও নিয়ম মেনে খাওয়ানো দরকার।

✅ কেবল শিশুকে নয়, পরিবারের সব সদস্যকেই একসঙ্গে কৃমির ওষুধ খেতে হবে, যাতে সংক্রমণ ফিরে না আসে।

✅ অনেক ক্ষেত্রে একবার ওষুধ খাওয়ালেই কৃমি দূর হয়ে যায়, তবে কিছু কৃমির জন্য দ্বিতীয় ডোজ প্রয়োজন হয়।

✅ কৃমি সংক্রমণ গুরুতর হলে বা অন্ত্রে বাধা সৃষ্টি করলে অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হতে পারে।


শিশুর কৃমি প্রতিরোধের উপায়

পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা:

  • শিশুকে টয়লেট ব্যবহারের পর ও খাবারের আগে সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার অভ্যাস করান।
  • শিশুর নখ ছোট ও পরিষ্কার রাখুন।

খাদ্য ও পানীয় সতর্কতার সাথে গ্রহণ করা:

  • রাস্তার বা অপরিষ্কার খাবার এড়িয়ে চলুন।
  • বিশুদ্ধ পানি পান করতে দিন।

খালি পায়ে হাঁটা বন্ধ করুন:

  • শিশুদের সবসময় জুতা বা স্যান্ডেল পরতে উৎসাহিত করুন।

নিয়মিত কৃমিনাশক ওষুধ খাওয়া:

  • ১ বছরের বেশি বয়সী শিশুদের ছয় মাস পরপর কৃমিনাশক ওষুধ খাওয়ানো উচিত (ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী)।
  • সরকারের কৃমি নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির আওতায় শিশুদের বিনামূল্যে ওষুধ দেওয়া হয়, তাই এটি গ্রহণ করতে উৎসাহিত করুন।

পরিবারের সবার সচেতনতা বৃদ্ধি করুন:

  • একজন আক্রান্ত হলে, পরিবারের অন্যদেরও চিকিৎসা করান।
  • পরিচারিকা বা বাড়ির অন্যান্য কর্মীদেরও নিয়মিত কৃমিনাশক ওষুধ খাওয়ান।

শিশুর সুস্বাস্থ্যের জন্য অভিভাবকদের করণীয়

শিশুর কৃমি সংক্রমণ এড়াতে প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপগুলো গুরুত্বসহকারে মেনে চলা উচিত। শিশুর ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা, স্বাস্থ্যকর খাবার ও বিশুদ্ধ পানি পান নিশ্চিত করলে কৃমি সংক্রমণের ঝুঁকি অনেকাংশে কমে যায়। সবসময় নজর রাখুন শিশুর স্বাস্থ্য ও অভ্যাসের দিকে, যাতে কোনো ধরনের সমস্যা দেখা দিলে তা প্রাথমিক অবস্থাতেই শনাক্ত করে দ্রুত সমাধান করা যায়।

শিশুর কৃমি সংক্রমণ প্রতিরোধে সচেতনতা ও নিয়মিত পরিচর্যা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ছোট ছোট অভ্যাস পরিবর্তনের মাধ্যমে শিশুর সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা সম্ভব, যা তার শারীরিক ও মানসিক বিকাশে সহায়তা করবে।



কেন কৃমি প্রতিরোধ জরুরি?

🔴 কৃমি শিশুর পুষ্টি শোষণ করে, ফলে তার বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়।
🔴 কৃমির কারণে রক্তস্বল্পতা হতে পারে, যা শিশুর মানসিক ও শারীরিক বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে।
🔴 গুরুতর সংক্রমণে অন্ত্রের বাধা সৃষ্টি হতে পারে, যা অপারেশন ছাড়া ঠিক করা সম্ভব নয়।
🔴 বাংলাদেশে ১০ বছরের নিচের ৩৯% শিশু কৃমিতে আক্রান্ত, যা বড় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।


শেষ কথা

শিশুর কৃমি প্রতিরোধের জন্য পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। অভিভাবকরা সচেতন হলে কৃমির সংক্রমণ কমানো সম্ভব। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো এবং কৃমিনাশক ওষুধ খাওয়ানোর মাধ্যমে শিশুকে সুস্থ রাখা যায়।শিশুর কৃমি প্রতিরোধের জন্য পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা, নিয়মিত কৃমিনাশক ওষুধ খাওয়ানো এবং স্বাস্থ্যকর খাবারের অভ্যাস গড়ে তোলা জরুরি।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

[blogger]

যোগাযোগ ফর্ম

নাম

ইমেল *

বার্তা *

Blogger দ্বারা পরিচালিত.
Javascript DisablePlease Enable Javascript To See All Widget