সাদকাতুল ফিতর এর বিস্তারিত বর্ণনা: ঈদের খুশিতে সামিল হোক দরিদ্রেরাও

রমজান মাসের শেষে যখন ঈদের খুশি দরজায় কড়া নাড়ে, তখন ইসলাম আমাদের শিখিয়ে দেয় যে, এই আনন্দ শুধু নিজের জন্য নয়—সমাজের প্রত্যেক দরিদ্র ও অসহায় মানুষকেও এই খুশিতে শামিল করা উচিত। 

সাদকাতুল ফিতর এর বিস্তারিত বর্ণনা: ঈদের খুশিতে সামিল হোক দরিদ্রেরাও

আর এই উদ্দেশ্যেই ইসলামে রয়েছে সাদকাতুল ফিতর বা সদকায়ে ফিতর নামের এক বিশেষ দান, যা ঈদের নামাজের আগে আদায় করা জরুরি।

সদকায়ে ফিতর কী?

সদকায়ে ফিতর, যা সংক্ষেপে ফিতরা নামেও পরিচিত, এটি একটি বাধ্যতামূলক দান, যা মুসলমানদের জন্য ওয়াজিব করা হয়েছে। এটি মূলত রমজান মাসে সিয়াম (রোজা) পালনের পর ঈদের দিনে গরিব ও অসহায় মানুষদের মাঝে বিতরণ করা হয়, যাতে তারা ঈদের আনন্দে অংশগ্রহণ করতে পারে।

হাদিসে এসেছে:

"রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, 'রোজাদারের জন্য এটি একটি পবিত্রতা, যা রোজার সময়ের অনর্থক কথা ও অশ্লীল কাজের গুনাহ মোচন করে এবং গরিবদের জন্য এটি খাদ্যের সংস্থান।' (আবু দাউদ, হাদিস: ১৬০৯)"


সদকায়ে ফিতরের পরিমাণ

সদকায়ে ফিতর (ফিতরা) ইসলামের এক গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত, যা ঈদুল ফিতরের দিন দরিদ্রদের সাহায্য করার জন্য নির্ধারিত। ফিতরা সম্পর্কে বিশুদ্ধ হাদিসসমূহ পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই যে, এটি পাঁচ প্রকার খাদ্যদ্রব্য দ্বারা আদায় করা হত:

১️⃣ যব (শইর)
2️⃣ খেজুর (তামর)
3️⃣ পনির (আকিত)
4️⃣ কিসমিস (জাবিব)
5️⃣ গম (বুর)

হাদিস অনুযায়ী, ফিতরার পরিমাণ হতে পারে:
✅ ৩.২ কেজি গম বা এর সমমূল্যের অর্থ
✅ ৩.২ কেজি যব বা এর সমমূল্যের অর্থ
✅ ৩.২ কেজি খেজুর বা কিসমিস
✅ ৩.২ কেজি পনির বা অন্যান্য খাদ্যপণ্য

 মোট কথা, হাদিসের নির্দেশনা অনুযায়ী,  (যব, খেজুর, পনির ও কিসমিস) দ্বারা ফিতরা দিতে হলে পরিমাণ হবে এক সা'। তবে গম দ্বারা আদায় করতে চাইলে দিতে হবে আধা সা'।


📖 প্রমাণিত হাদিসসমূহ:

১️⃣ আবু সাঈদ খুদরী (রা.) থেকে বর্ণিত:

كنا نخرج زكاة الفطر صاعًا من طعام أو صاعًا من شعير أو صاعًا من تمر أو صاعًا من أقط أو صاعًا من زبيب، وذلك من صاع النبي صلى الله عليه وسلم.
📖 (মুয়াত্তা মালেক, পৃষ্ঠা ১২৪; আল-ইসতিজকার, হাদিস ৫৮৯, ৯/৩৪৮)

🔹 আমরা নবী করিম (সা.)-এর সময় এক ‘সা’ খাদ্য, যব, খেজুর, পনির বা কিসমিস দ্বারা সদকায়ে ফিতর আদায় করতাম।


২️⃣ হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন:

إن أصحابي سلكوا طريقا وأنا أحب أن أسلكه.
📖 (আল-ইসতিজকার, হাদিস ৫৯০, ৯/৩৫৪)

🔹 "আমার সাহাবিরা যে পথ অনুসরণ করেছেন, আমিও সে পথেই চলতে আগ্রহী।"
🔹 হযরত ইবনে ওমর (রা.) সাহাবাদের আমল অনুসরণ করে সারাজীবন খেজুর দ্বারা ফিতরা আদায় করতেন।


৩️⃣ উত্তম দান সম্পর্কে নবী (সা.) বলেন:

أغلاها ثمنا وأنفسها عند أهلها.
📖 (সহীহ বুখারী, কিতাবুল ইতক ৩/১৮৮; সহীহ মুসলিম, কিতাবুল ঈমান ১/৬৯)

🔹 "দাতার কাছে যা সর্বোৎকৃষ্ট এবং যার মূল্য সবচেয়ে বেশি, সেটাই উত্তম দান।"



🌾 সদকায়ে ফিতরের হিসাব (২০২৫ অনুযায়ী) 📊

বর্তমান বাজারদরের ভিত্তিতে নিম্নলিখিত খাদ্যদ্রব্যের দ্বারা ফিতরার হিসাব করা যেতে পারে:

খাদ্যদ্রব্যপরিমাণ (কেজি)প্রতি কেজির দাম (টাকা)ফিতরার পরিমাণ (টাকা)
আজওয়া খেজুর৩.২৫৬ কেজি১০০০৩২৫৬
মধ্যমমানের খেজুর৩.২৫৬ কেজি৩০০৯৭৭
কিসমিস৩.২৫৬ কেজি২৩০৭৪৮
পনির৩.২৫৬ কেজি৫০০১৬২৮
গম১.৬৩ কেজি৩৫৫৭

📝 🔹 হাদিসের নির্দেশনা অনুযায়ী, যাদের সামর্থ্য রয়েছে, তারা উন্নতমানের খাদ্যদ্রব্যের হিসাব অনুযায়ী ফিতরা আদায় করবেন।



💡 কেন সর্বনিম্ন মূল্যের খাদ্যদ্রব্যই ফিতরা হিসেবে গ্রহণ করা ঠিক নয়?

☑️ সাহাবায়ে কেরাম যুগে যখন গমের দাম বেশি ছিল, তখন তারা গমকেও এক ‘সা’ খাদ্যদ্রব্যের সমতুল্য গণ্য করতেন।
☑️ বর্তমানে গমের দাম সবচেয়ে কম হওয়ায়, শুধুমাত্র গমের মূল্যে ফিতরা আদায় করাই যথেষ্ট নয়।
☑️ সামর্থ্যবানদের উচিত, ফিতরা দেওয়ার সময় গমের পরিবর্তে খেজুর, কিসমিস বা অন্য উচ্চমূল্যের খাদ্যের হিসাব গ্রহণ করা।

📌 ইবনে মুনযির বলেন:

فلما كثر في زمن الصحابة رأووا أن نصف صاع منه يقوم مقام صاع من شعير.
📖 (ফাতহুল মুলহিম ৩/১৫; আওজাযুল মাসালিক ৬/১৩)

🔹 "যখন সাহাবাদের যুগে গম সহজলভ্য হল, তখন তারা আধা ‘সা’ গমকে এক ‘সা’ যবের সমান মনে করলেন।"


সদকায়ে ফিতর কার উপর ওয়াজিব?

ফিতরা আদায় করার জন্য কিছু নির্দিষ্ট শর্ত রয়েছে। যেসব মুসলমানের উপর এটি ওয়াজিব হয়, তারা হলেন:
1️⃣ প্রাপ্তবয়স্ক মুসলিম—ছোটদের পক্ষ থেকে অভিভাবক আদায় করবে।
2️⃣ নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক—যার অতিরিক্ত প্রয়োজনের বাইরে ন্যূনতম নিসাব পরিমাণ সম্পদ রয়েছে।
3️⃣ ঈদের দিন সুবহে সাদিকের সময় জীবিত থাকা—যারা ঈদের দিন সুবহে সাদিকের সময় জীবিত থাকবে, তাদের উপর ফিতরা ওয়াজিব হয়।

আরো পড়ুন


সদকায়ে ফিতর কাকে দেওয়া যাবে?

সদকায়ে ফিতর ইসলামে এমন ব্যক্তিদের দেওয়া হয়, যারা আর্থিকভাবে অসচ্ছল এবং যাকাত পাওয়ার যোগ্য। নিম্নে উল্লেখিত শ্রেণির লোকদের ফিতরা দেওয়া যায়—

১️⃣ গরিব ও মিসকিন (অত্যন্ত অভাবী ব্যক্তি)

গরিব – যার মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য পর্যাপ্ত সম্পদ নেই এবং নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক নয়
মিসকিন – যার এতটাই অভাব যে, জীবিকা নির্বাহের জন্য পর্যাপ্ত সামর্থ্যও নেই।

২️⃣ ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি (গরিব দেনাদার)

✅ যে ব্যক্তি ঋণের ভারে এতটাই জর্জরিত যে, তার মৌলিক চাহিদা পূরণের মতো অর্থ নেই, তাকে ফিতরা দেওয়া যেতে পারে। তবে যদি সে ধনী হয়, কিন্তু কোনো কারণে ঋণগ্রস্ত, তবে তাকে দেওয়া যাবে না।

৩️⃣ পথ ভিক্ষুক (যারা জীবিকার কোনো উপায় খুঁজে পায় না)

✅ যেসব ব্যক্তি চাকরি বা কাজের সুযোগ না পাওয়ায় অভাব-অনটনে দিন কাটাচ্ছে, তাদের ফিতরা দেওয়া যায়।

৪️⃣ মুসাফির (যাত্রাপথে অসহায় ব্যক্তি)

✅ যে ব্যক্তি সফরে আছে এবং তার কাছে প্রয়োজনীয় সম্পদ বা অর্থ নেই, তাকে ফিতরা দেওয়া যায়, যদিও সে নিজ এলাকায় অবস্থান করলে ধনী হয়।

৫️⃣ কর্মহীন ও বেকার ব্যক্তি

✅ যারা চাকরি বা কাজ করতে সক্ষম হলেও সুযোগের অভাবে আর্থিকভাবে অসহায় অবস্থায় রয়েছে, তারা ফিতরা পাওয়ার উপযুক্ত।

৬️⃣ এতিম ও বিধবা

✅ যদি এতিম শিশু বা বিধবা আর্থিকভাবে অসহায় হয়, তবে তাদের ফিতরা দেওয়া যায়। তবে, এতিম শিশু যদি ধনী হয় বা সম্পদের মালিক হয়, তাহলে তাকে দেওয়া যাবে না।

৭️⃣ শিক্ষার্থী বা ধর্মীয় জ্ঞান অন্বেষণকারী (যারা গরিব)

✅ যারা দ্বীনি জ্ঞান অর্জন করছে কিন্তু তাদের মৌলিক প্রয়োজন মেটানোর মতো আর্থিক সামর্থ্য নেই, তাদের ফিতরা দেওয়া যায়।

৮️⃣ শারীরিকভাবে অক্ষম বা প্রতিবন্ধী ব্যক্তি

✅ যারা শারীরিক অক্ষমতার কারণে কাজ করতে পারে না এবং তাদের জীবিকা নির্বাহ করা কঠিন, তারা ফিতরার হকদার।


সদকায়ে ফিতর কাকে দেওয়া যাবে না?

সদকায়ে ফিতর বিতরণের ক্ষেত্রে ইসলামে কিছু স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। ফিতরা দেওয়া যাবে না এমন কিছু ব্যক্তি ও শ্রেণি নিম্নে উল্লেখ করা হলো:

১️⃣ নিজের পরিবার ও আত্মীয়দের মধ্যে কিছু ব্যক্তি

নিজের পিতা-মাতা, দাদা-দাদি, নানা-নানি – যাদের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব সন্তানদের ওপর রয়েছে।
নিজের সন্তান, নাতি-নাতনি – যাদের ভরণ-পোষণ দেওয়া ওয়াজিব।
নিজের স্ত্রী – স্বামী তার স্ত্রীকে ফিতরা দিতে পারবেন না, কারণ তার ভরণ-পোষণের দায়িত্ব স্বামীর ওপর রয়েছে।
স্বামীকে স্ত্রী ফিতরা দিতে পারবে না – কারণ স্বামীকে সহায়তা করা স্ত্রীর দায়িত্ব নয়।

২️⃣ ধনী ও স্বচ্ছল ব্যক্তিরা

✅ যে ব্যক্তি নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক, অর্থাৎ যার মৌলিক প্রয়োজন মিটিয়ে সাড়ে ৫২ তোলা রূপা বা সাড়ে ৭.৫ তোলা স্বর্ণ বা তার সমমূল্যের সম্পদ রয়েছে, সে ফিতরা গ্রহণ করতে পারবে না।

৩️⃣ বিত্তবান ও সামর্থ্যবান ব্যক্তি

✅ যে ব্যক্তি কর্মক্ষম এবং উপার্জন করার সামর্থ্য রাখে, কিন্তু অলসতার কারণে কাজ করে না, সে ফিতরা পাওয়ার যোগ্য নয়।

৪️⃣ কাফের ও অমুসলিমরা

✅ সদকায়ে ফিতর শুধুমাত্র মুসলমানদের জন্য নির্ধারিত, তাই কোনো অমুসলিম ব্যক্তি ফিতরা গ্রহণ করতে পারবেন না।

৫️⃣ নিজের ব্যবসায়িক পার্টনার বা সুবিধাভোগী ব্যক্তিরা

✅ যদি ফিতরা দান করার মাধ্যমে দাতার ব্যক্তিগত লাভ হয় (যেমন ব্যবসার অংশীদারকে দেওয়া হয়, যাতে সে ভবিষ্যতে কোনোভাবে সাহায্য করে), তবে তা দেওয়া জায়েজ নয়।

৬️⃣ সাইয়্যেদ (রাসূল ﷺ-এর বংশধর)

✅ রাসুলুল্লাহ (সা.) এর বংশধর (সাইয়্যেদ) বা বনী হাশিমের বংশধরদের জন্য যাকাত, সদকাহ ও ফিতরা গ্রহণ করা নিষিদ্ধ


ফিতরা আদায়ের সময় ও নিয়ম

📌 ঈদের নামাজের আগে ফিতরা আদায় করা উত্তম। তবে কেউ চাইলে রমজানের শেষ দশকেও এটি আদায় করতে পারেন, যাতে গরিব মানুষরা ঈদের প্রস্তুতি নিতে পারে।

✅ সহজ উপায়ে ফিতরা আদায় করা যায়:

  • স্থানীয় মসজিদ বা ইসলামী সংস্থার মাধ্যমে

  • প্রত্যক্ষভাবে গরিবদের হাতে তুলে দিয়ে

  • অনলাইন ইসলামী দাতব্য সংস্থার মাধ্যমে


সদকায়ে ফিতরের গুরুত্ব ও উপকারিতা

✅ এটি রোজার শুদ্ধতা বজায় রাখে
✅ সমাজের গরিব মানুষদের ঈদের আনন্দে সামিল করে
✅ ধনীদের মধ্যে দাতব্য প্রবণতা ও সহমর্মিতা বাড়ায়
✅ সামাজিক বৈষম্য দূর করে ও সম্প্রীতি গড়ে তোলে

 আরো জানুন

নবজাতকের যত্নে প্রচলিত ভুল ধারণা ও কুসংস্কার: যে ভুলগুলো কখনোই করা উচিত নয়

রাতে বা দিনে শিশুরা অতিরিক্ত কান্না করলে যে সুরা পাঠ করবেন

ইসলামে মেহেদি ব্যবহারের বিধান: নারী, পুরুষ ও শিশুর জন্য বিস্তারিত ব্যাখ্যা


আরো ইনফো

গালি দেওয়া ইসলামে নিষিদ্ধ: কারণ, পরিণতি ও করণীয়


উপসংহার

সদকায়ে ফিতর শুধু একটি দান নয়, এটি আমাদের ঈদের আনন্দকে পূর্ণতা দেয়। এটি একটি দায়িত্ব, যা সম্পদশালীদের ধনসম্পদের শুদ্ধি আনতে সহায়তা করে এবং দরিদ্রদের মুখে হাসি ফোটায়। তাই ঈদের আগেই ফিতরা আদায় করুন, যেন সমাজের সকল শ্রেণির মানুষ ঈদের আনন্দ ভাগ করে নিতে পারে।

📌 এ বছর আপনার ফিতরা কি আদায় হয়েছে? আজই আদায় করুন এবং একটি দরিদ্র পরিবারের মুখে হাসি ফুটান! 😊

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

[blogger]

যোগাযোগ ফর্ম

নাম

ইমেল *

বার্তা *

Blogger দ্বারা পরিচালিত.
Javascript DisablePlease Enable Javascript To See All Widget