যাকাত শব্দের অর্থ হলো পবিত্রতা ও প্রবৃদ্ধি। এটি শুধু ধনী ও গরিবের মধ্যে সম্পদ বণ্টনের একটি উপায় নয়, বরং আত্মার পরিশুদ্ধি এবং দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণের অন্যতম মাধ্যম। যাকাত ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের একটি, যা প্রত্যেক সামর্থ্যবান মুসলমানের জন্য ফরজ।
এটি ইসলামী অর্থনীতির অন্যতম ভিত্তি, যা সমাজে অর্থনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখে।
যাকাতের গুরুত্ব ও ফজিলত
পবিত্র কুরআনে ৮২ বার যাকাতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যা এর গুরুত্বকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরে। আল্লাহ তায়ালা বলেন—
❝তাদের (ধনীদের) ধন-সম্পদে রয়েছে অভাবগ্রস্ত ও বঞ্চিতের অধিকার।❞
(সুরা আয-জারিয়াত: ১৯)
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন—
❝দান-সদকা পাপকে এমনভাবে দূর করে, যেভাবে পানি আগুন নিভিয়ে দেয়।❞ (তিরমিজি, হাদিস: ৬০৪)
যাকাতের উপকারিতা
✅ সম্পদ পবিত্র হয় ও বরকত বৃদ্ধি পায়।
✅ গুনাহ মোচন হয় ও আত্মার পরিশুদ্ধি ঘটে।
✅ দরিদ্রদের সহায়তা হয়, সমাজে অর্থনৈতিক ভারসাম্য আসে।
✅ লোভ, কৃপণতা ও সম্পদের অহংকার দূর হয়।
✅ বিপদ-আপদ ও আল্লাহর শাস্তি থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
কারা যাকাত আদায় করবেন?
যাকাত ফরজ হওয়ার জন্য নির্দিষ্ট শর্ত রয়েছে—
✅ মুসলিম হতে হবে।
✅ পূর্ণবয়স্ক ও সুস্থ মস্তিষ্কের হতে হবে।
✅ স্বাধীন হতে হবে (দাস নয়)।
✅ সম্পদের উপর পূর্ণ মালিকানা থাকতে হবে।
✅ নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকতে হবে এবং তা এক বছর অতিক্রান্ত হতে হবে।
✅ সম্পদ ঋণমুক্ত হতে হবে (অর্থাৎ নিসাব পরিমাণ ঋণের বাইরে অতিরিক্ত থাকতে হবে)।
যাকাতের নিসাব ও হিসাব
যাকাত ফরজ হওয়ার জন্য সম্পদের পরিমাণ অবশ্যই নির্দিষ্ট সীমার (নিসাব) উপরে হতে হবে।
🔹 স্বর্ণ: ৭.৫ তোলা (৮৭.৫ গ্রাম)
🔹 রূপা: ৫২.৫ তোলা (৬১২.৩৫ গ্রাম)
🔹 নগদ অর্থ ও ব্যবসার মাল: রূপার বাজারমূল্যের সমপরিমাণ হতে হবে।
📌 যাকাতের হার: সম্পদের মোট পরিমাণের ২.৫% (৪০ ভাগের ১ ভাগ) যাকাত দিতে হয়।
🔹 উদাহরণ:
আপনার কাছে যদি ১,০০,০০০ টাকা থাকে, তবে এর ২.৫% = ২৫০০ টাকা যাকাত দিতে হবে।
যেসব সম্পদের ওপর যাকাত ফরজ
💰 নগদ অর্থ: ব্যাংক ব্যালান্স, ফিক্সড ডিপোজিট, বন্ড, শেয়ার ইত্যাদি।
👑 স্বর্ণ ও রুপার অলংকার: ব্যবহৃত হোক বা না হোক, যাকাত দিতে হবে।
🏠 ব্যবসার মালামাল: ব্যবসার জন্য ক্রয় করা পণ্য, জমি, দালান ইত্যাদির ওপর যাকাত দিতে হবে।
🐄 পশুসম্পদ: নির্দিষ্ট পরিমাণ গবাদি পশুর ওপর যাকাত ফরজ।
📌 মৌলিক প্রয়োজনীয় সম্পদের ওপর যাকাত নেই, যেমন—নিজের বাসস্থান, ব্যবহৃত গাড়ি, দৈনন্দিন জীবনের আসবাবপত্র, বই-পত্র, খাদ্যসামগ্রী ইত্যাদি।
যাকাত কাদের দেওয়া যাবে?
পবিত্র কুরআনে যাকাতের জন্য ৮ শ্রেণির মানুষ নির্ধারণ করা হয়েছে—
1️⃣ দরিদ্র: যাদের কাছে কোনো সম্পদ নেই।
2️⃣ মিসকিন: যারা অভাবী, তবে ভিক্ষা করে না।
3️⃣ যারা যাকাত সংগ্রহ ও বিতরণের দায়িত্বে নিযুক্ত।
4️⃣ নতুন মুসলিম, যাদের অন্তর ইসলামের দিকে আকৃষ্ট করতে হয়।
5️⃣ দাস-মুক্তির জন্য।
6️⃣ ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি, যাদের ঋণ শোধের সামর্থ্য নেই।
7️⃣ আল্লাহর পথে ব্যস্ত মুজাহিদ ও দ্বীনের প্রচারক।
8️⃣ মুসাফির, যারা আর্থিক সংকটে পড়েছে।
❌ যাকাত দেওয়া যাবে না:
- নিজের বাবা-মা, দাদা-দাদি, নানু-নানী।
- নিজের সন্তান, নাতি-নাতনি।
- নিজের স্ত্রী বা স্বামী।
- ধনী বা সম্পদশালী ব্যক্তি।
রমজানে যাকাত আদায়ের গুরুত্ব
রমজান মাস শুধু রোজার জন্য নয়, বরং এটি আত্মশুদ্ধি, দান-খয়রাত ও গরিব-দুঃখীদের প্রতি সহমর্মিতা প্রদর্শনের মাস। এ মাসে যাকাত দিলে সওয়াব আরও বৃদ্ধি পায়।
কুরআনে বলা হয়েছে:
❝তোমরা নামাজ আদায় করো ও যাকাত প্রদান করো এবং রুকুকারীদের সঙ্গে রুকু করো।❞ (সূরা বাকারা: ৪৩)
হাদিসে বলা হয়েছে:
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন—
❝যাকে আল্লাহ সম্পদ দিয়েছেন, কিন্তু সে তার যাকাত দেয়নি, কেয়ামতের দিন তা বিষধর সাপের রূপ ধারণ করবে এবং তার গলায় পেঁচিয়ে দেওয়া হবে।❞ (সহিহ বুখারি)
যাকাত আদায়ের মাধ্যমে অর্জিত কল্যাণ
১. আত্মশুদ্ধি ও পাপমুক্তি: যাকাত আদায় করলে মানুষের হৃদয় কৃপণতা ও লোভ থেকে মুক্ত হয় এবং সম্পদ পবিত্র হয়।
২. সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠা: যাকাতের মাধ্যমে ধনীরা গরিবদের পাশে দাঁড়ায়, ফলে সমাজে অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা হয়।
3. আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন: পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেছেন—
“যারা নিজেদের ধন-সম্পদ আল্লাহর পথে ব্যয় করে, তাদের দৃষ্টান্ত সেই শস্যবীজের ন্যায়, যা সাতটি শিষ উৎপন্ন করে এবং প্রত্যেক শিষে একশ শস্যদানা থাকে।”
(সূরা বাকারা: ২৬১)
সম্পদের বরকত বৃদ্ধি: রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন—
“দান করলে সম্পদ কমে না, বরং তা বরকতময় হয়।”
(সহিহ মুসলিম)
আরো পড়ুন
🔹 শিশুর বয়স অনুযায়ী প্রসাবের বিধান: হাদিসের আলোকে জানুন!
নতুন মায়েদের জন্য ধর্মীয় বিধান: রোজা ও নামাজ সংক্রান্ত জরুরি তথ্য
২️⃣ স্বামী কতদিন দূরে থাকতে পারে? ইসলামের দৃষ্টিতে করণীয় ও বিধান 🏡📜
💖 ঈদের প্রস্তুতি হোক আত্মশুদ্ধি, মানবতা ও ভালোবাসার প্রতিচ্ছবি
শেষ কথা
যাকাত শুধু গরিবের অধিকার নয়, বরং ধনীদের জন্যও একটি পরীক্ষা। এটি সম্পদের ভারসাম্য রক্ষা করে, সমাজকে কল্যাণের পথে পরিচালিত করে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে সাহায্য করে।
💚 আসুন, পবিত্র রমজানে আমাদের সম্পদকে পরিশুদ্ধ করি, অভাবী ও অসহায়দের পাশে দাঁড়াই, এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করি! 🌿✨
আরে পড়ুন
পরিত্র রমজান মাসে কি কি কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখবেন?
রমজানে গর্ভবতী মা: সুস্থতা, ইবাদত ও সন্তানের জন্য বরকতময় আমল
নতুন মায়েদের জন্য ধর্মীয় বিধান: রোজা ও নামাজ সংক্রান্ত জরুরি তথ্য
রোজা রেখে নখ কাটা বা গুপ্তাঙ্গের লোম পরিষ্কার করা যাবে? জানুন বিস্তারিত!
🕌 রমজানে যৌন সম্পর্ক করা যাবে কি না? কারা রোজা রাখবে? – বিস্তারিত ব্যাখ্যা
আপনার সন্তানকে কিভাবে রোজা রাখার জন্য উৎসাহিত করবেন ও কেন?
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন